পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জ্যৈষ্ঠ “বলব কেন ? সত্যিই ত আর উড়ে আসি নি! লিভিংষ্টোন সাজতে গেলে বুদ্ধি আর নজরটাকে একটু পরিস্কার রাখা চাই। একটু নজর করলেই দেখতে পেতেন যে পশ্চিমের আমবাগানটা নদীর উপর গিয়ে নেমেছে। তাঁর তলাট। বেশ চলনসই পরিষ্কার। বোটটা নিয়ে একটু বেয়ে গিয়ে উঠে তার ভেতর দিয়ে বাড়ির দেউড়ির উল্টে দিকের কাঁঠালতল দিয়ে এসে উঠলাম । উঃ, আর এক মিনিট দেরি হ'লেই আপনার আমাকে নীচের তলায় ধ'রে ফেলেছিলেন আর কি ! ভাগ্যিস সামনেই রেলিঙের একটা শিক পড়ে ছিল, তাই দিয়ে এক টানে শিকলের হস্কাটা উপড়ে ফেলে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে এলাম। এসে মনে হ’ল মশায়দের সাহসট একটু পরখ ক'রে দেখা যাকৃ। তা ভোলাদ না থাকলে বোধ হয় মশায় সিড়ির তলাতেই দাঁতকপাটি লেগে পড়ে থাকৃতেন ।" ভোলানাথ এতক্ষণ একটাও কথা বলতে পারে নি। এই মেয়েটিব দুৰ্জ্জয় সাহস ও বুদ্ধিতে তার অশিক্ষিত সাদ বলিষ্ঠ মন প্রশংসায় ভরপূর হয়ে উঠেছিল। এখনও সে কোন কথা না ব'লে প্রাণ খুলে তার প্রকাও দরাজ গলায় হা: তা: ক’রে হেসে উঠল—যেন তণর মনের সমস্ত প্রশংসার উচ্ছ্বাস একটা বিরাট হাসিতে তল্পমা ক’রে দিলে। শচীন্দ্রনাথের মনটাও প্রশংসায় উচ্ছসিত হ’য়ে উঠেছিল, কিন্তু তার নিজের ভীরুতায় তার লজ্জাও কম হচ্ছিল • । সে একটু লজ্জিতভাবে হেসে বললে “উ, কি নিদারুণ চাংকারই না করেছিলে । কোন মামুযের গলায় যে এমন আওয়াঙ্গ বেরোয় তা ভাবতেই পারি নি।” বলে নিজের ভয়ের কথা মনে ক’রে বোধ হয় সঙ্কোচে চুপ ক’রে গেল । শচীন্দ্র লজ্জ পেয়েছে দেখে পৰ্ব্বতী বললে, “ভাবছেন কি চুপ ক'রে ? ভাবছেন তো, যে মেয়েট কি বেহায় ; দেশে এমন মেয়ের স্থান হওয়া উচিত নয়—?” শচীন বললে, “না, ভাবছি স্কটল্যাগুয়িয়ার্ডের কৃতিত্ব নিতান্তই বাজে গল্প ; কিংবা বাঙালীর মেয়ের জুড়িদার মাথা বিলেতে নেই। নইলে...মানে...” ব’লে হাসতে লাগল । “নইলে কি ? নইলে এ মেয়েট জেলের বাইরে এখনও ছাড়া আছে কেমন করে, এই তো ? তালাভাঙার কথা তো ? তা, ধরা পড়বার ভয়ে ইনস্টংক্ট অব সেলফ-প্রিজারভেশন মানুষের আপনিই জাগে।” এই বলে, কথাটাকে চাপা দেবার ংলা মানুষের মন 戈8° জন্যে বললে, “এই কোটটা ধর তো ভোলাদ, ওর পকেটে একটা কাগজে সন্দেশ আর ফ্লাস্কে সরবৎ আছে । একটু খেয়ে ঠাণ্ড হোন। অন্তত মুখটা বন্ধ হোক ৷” এমন সময় দেখা গেল বারান্দার দেয়ালের কোণ থেকে বাহাদুর সিং উকি মেরে দেখছে। দেথছে হ’ল কি ! এতক্ষণ নীচে বসে বসে সে নানা কাল্পনিক প্রেতিনীতত্ত্ব আলোচনা ক'রে ভয়ে এবং কল্পনায় বিভীষিকার জাল বুনছিল, এবং শচীন্দ্র ও ভোলানাথের অকস্মাৎ উধাও হওয়া সম্বন্ধে পিসীমাকে কি কি উপযুক্ত কৈফিয়ৎ দিতে পারে তার একটা গল্প, ভৌতিক কল্পনা এবং তাদের উদ্ধারকল্পে নিজের বীরত্বের সঙ্গে মিলিয়ে সে এতক্ষণ ধ’রে মনে মনে প্রস্তুত ক’রে রাখছিল। অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন চেঁচামেচি, বন্দুক ছোড়াছুড়ি, হুড়হাঙ্গামের কোন লক্ষণ দেখতে পাওয়া গেল না বরং উপর থেকে হাসি এবং কথাবাৰ্ত্তার শবাই পাওয়া যেতে লাগল, তখন রীতিমত একটু নিরাশ এমন কি বিরক্ত হয়েই সাবধানে উপরে উঠে গেল। কথার শব্দ অনুসরণ ক'রে বারান্দার একটা মোড়ে গিয়ে উকি মেরে দেখছিল, যে, বাবু এবং অমুচর যে পেত্নীদের সঙ্গে এভাবে আডডা জমাতে পারে তাদের চেহারাটা কি রকম। সব চেয়ে আগে চোখ পড়ল পাৰ্ব্বতীর । সে বললে, “এস এস বাহাদুর সিং । তোমার আশ্চৰ্য্য সাহসে সকলের তাক লেগে গেছে । সরকার বাহাদুর টের পেলে তোমাকে পণ্টনে নিয়ে গিয়ে কাপ্তেম বানিয়ে দেবে।” বাহাদুর সিং খুব সপ্রতিভ ভাবে এগিয়ে এল এবং প্রথমে পাৰ্ব্বতীকে ৪ পরে ভোলানাথকে ফৌজী কায়দায় সেলাম ঠুকে বন্দুকটাকে নিয়ে খাড়া দাড়িয়ে কুংকুৎ ক'রে চাইতে লাগল। শচীন্দ্র যে আদং মনিব, তা সে যেন গ্রাহের মধ্যেই আনল না। ভোলানাথ এষ্ট দেখে ভারি চটে গেল। তার বাবুকে এই নতুন-আমদানী পাহাড়েতৃতটা যে অগ্রাহ করবে তা সে সহ করতে পারবে কেন ? রেগে বললে, “বেরো ব্যাট হকুমান এখান থেকে ; বঁfদর-নাচ দেখাতে এসেছে, বেরে। " বাহাদুর আবার ফৌজী কায়দায় রীতিমত সেলাম ঠকে, রাইট এবাউট টার্ণ ও কুইক মার্চ ক’রে বারান্দার অন্য দিকে চলে গেল। ভোলানাথ বললে, “বাবু, ঘরের দরজাগুলো খোল্বার চেষ্টা করি। আপনার বরং এখানে একটু অপিক্ষে করুন।” ( ক্রমশ: )