জ্যৈষ্ঠ ১৪ই ডিসেম্বরে আমরা দুই জনে ঐ পুলিসদের দেওয়া চারপায়ায় বিশ্রাম করিলাম। সত্যই এই সজ্জন সিপাহীরা না থাকিলে এইরূপ মনুষ্যবসতিবিহীন গহনে যাত্রীদিগের অশেষ কষ্ট হইত। রাত্রে ইহাদের গরম গরম রুটিতে আমাদের ক্ষুধা নিবারণ হইল। স্বথর মহাশয় ভাগ্যবান, তাহার জন্ম গরম চাও জুটিয়া গেল। ১৫ই ডিসেম্বর আমরা পদব্রজে দৌলতাবাদ চলিলাম। পথে খুলদাবাদে সম্রাট ঔরংজেবের সমাধি দেখিলাম। ইহার সম্মুখে পীর জৈমুদিনের কবর রহিয়াছে। দেবগিরির ( দৌলতাবাদ ) সুদূরবিস্তৃত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, একাস্তে দণ্ডায়মান শৈলসমুদেশে স্থিত বহু সরোবর, দ্বার, প্রাকার, গোলকধাঁধ, জলাশয়, মন্দিরধ্বংসাংশ, মিনার-গম্বুজবিশ্রামাগার যুক্ত বিকট সুগ এখনও মানুষের মনে স্মিয় আনয়ন করে। এই দেবগিরিবাসীদিগের শ্রদ্ধ-বিভূতির অক্ষয় স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ উপরি-উক্ত কৈলাস ও অন্যান্য গুহামন্দির এখনও বর্তমান । সে সকল দেখিলেও হৃদয় গৰ্ব্বে স্ফীত হয়। কি করিয়৷ ইহার অধিস্বামী পরাজিত হইতে পারিলেন তাহা চিন্তার অতীত ; পরাজিত কিন্তু সত্যই যে হইয়াছিলেন তাহাতেও সন্দেহের অবকাশ নাই । তৃতীয় প্রহরে আমরা ঔরঙ্গাবাদ অভিমুথে চলিলাম। সুথর মহাশয় আগেই ডাকবাংলায় থাকিবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন । পরদিন আমিও অজণ্ট যাইব, সুতরাং আমার জিনিষপত্রও ঐখানেই আনিলাম । শুনিয়াছিলাম ফৰ্দ্দাপুরের বাস সকালেই ছাড়ে। কাৰ্য্যকালে বেলা নয়টায় ছাড়িল । নিজাম-সরকার সমস্ত বাসের ঠিক এক জনকে মাত্র দেওয়ায় যাত্রীদের সময় অর্থ ইত্যাদি সব দিকেই লোকসান হইতেছে । আমরা কোনপ্রকারে বেলী একটায় ফৰ্দ্দাপুরের ডাকবাংলায় পৌছিলাম। গভর্ণর-বাহাদুর তখন অজণ্ট দেখিয়া চলিয়া গিয়াছেন, শুধু তাবু ও অন্ত লটুবহর পড়িয়া আছে । থাওয়ার পাট সাঙ্গ করিয়া আমরা অজণ্টার দিকে ছুটিলাম। প্রায় তিন মাইল পথ অতিক্রম করিয়া বহু দিনের অভিলাষ পূর্ণ হইল। বিভিন্ন কাল নিৰ্ম্মিত নানা গুহার অভ্যস্তরে অতি স্বন্দর চিত্রপ্রতিম, কক্ষশীলাবিন্যাস ইত্যাদি নিষিদ্ধ দেশে সওয়া বৎসর ኟግû অতৃপ্ত নয়নে দেখিতে লাগিলাম। নির্জন স্থানে জলের সান্নিধ্য, পৰ্ব্বতের শ্যামশোভা। অজন্টার প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্যও এইরূপ অনুপম । ভাল করিয়া দেখিবার পূর্বেই “বন্ধ হইবার সময় হইয়াছে” ঘোষণা শুনিলাম, কোন প্রকারে দেখা শেষ করিতে হইল । ফিরিবার পথে স্থর মহাশয় প্রাচীন কীৰ্ত্তির কথা প্রসঙ্গে বর্তমান ভারতের অবস্থারও চর্চা আরম্ভ করিলেন । তিনি বর্তমান ভারতের রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা এবং সঙ্গে সঙ্গে জাতিগত অবসয় ভাবের উল্লেখ করিলেন। আমি বলিলাম, “উদ্দেশ্বের কথায় বলা যাইতে পারে, আমাদের উদ্দেশ্য তাহাই যাহা উদীয়মান জাতির হওয়া উচিত এবং ইহাও নিঃসন্দেহ যে বাধাবিঘ্ন ঘটিলেও জাতির উদ্দিষ্ট পখে অগ্রগতি অনিবাৰ্য্য। চিত্তবিক্ষেপ ও মানসিক অবসাদ আমাদের বিশেষ দুৰ্ব্বলতার পরিচায়ক, সন্দেহ নাই। জাতীয়তা ও ধৰ্ম্ম দুইটি সম্পূর্ণ পথক বস্তু। একের স্থানে অন্তকে স্থাপন করা অসম্ভব। ইহা সত্য যে একের প্রভাব অন্যের উপর আসেই এবং তাহা অনুচিতও নহে। তথাপি যদি কোন ধৰ্ম্ম কোন জাতির সুদূর অতীত হইতে আবহমান জাতীয়তা ও সংস্কৃতির প্রবাহকে স্থানচ্যুত করিয়া সেই স্থানে অন্য কিছু স্থাপন করিতে চাহে, তবে বলিতে হইবেই যে উহা তাহার পক্ষে বিশেষ ধৃষ্টতা ও একান্ত অস্বাভাবিক কাৰ্য্য। হিন্দুস্থানে ইসলাম এই ভুল করিয়াছেন এবং খ্ৰীষ্টানদিগেরও অনেকেই করিতেছেন।” স্বথর মহাশয় বলিলেন, “আমরাও ইহা পছন্দ করি না।” আমি বলিলাম, ছুৎমার্গ'ও আগের মত কোথায় ? যাহা আছে তাহাই বা কয় দিনের জন্ত ? তবে কেন হিন্দুস্থানী নাম, হিন্দুস্থানী বেশ, হিন্দুস্থানী ভাষা ও সংস্কৃতি রাখিয়া সাচ্চ খ্ৰীষ্টান হওয়া যায় না ? আমি অবশ্ব স্বীকার করি যে অধিকাংশ আমেরিকান পাদরীও ঐরুপ জাতিভ্ৰষ্ট হওয়া পছন্দ করেন ন} } তিনি বলিলেন, “এই বার আমাদের যাবতীয় ভারতীয় মিশনে সাক্ষাংভাবে এই বিষয়ের আলোচন, অবশুই করিব।” আমি বলিলাম, “যদি এই প্রকারে ভারতীয় মুসলমানেরাও ঐ পন্থা ধরিতেন তবে এই বিচ্ছেদ ঘটিত না। তবে সে
পাতা:প্রবাসী (ষট্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২৮৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।