তাণষণঢ় গ্রামের মেয়েদের জল আনি তখনও শেষ হয় নাই । খন গাছের ভিতর হইতে সরু সরু পথে স্বচ্ছন্দগতি সাওতালকন্যারা মাথায় কলসী ও কোলে উলঙ্গ সুপুষ্ট কালে ছেলে লইয়া নদীর ঘাটে আসিতেছে। মাঝে মাঝে একটু মাজা রঙের শীর্ণকায় বাঙালীর মেয়েও দেখা দিতেছিল। একই গ্রামে বাস, একই পথে হাট চল, কিন্তু সাওতাল-মেয়েদের খোলা মাথা, নিটোল আঁট গড়ন, দৃপ্ত চলার ভঙ্গী, আর বাঙালীর মেয়ের মাথার ঘোমট, টিলা শরীর, ঝুঁকিয় সলজ্জভঙ্গীতে চলা দেখিলে আকাশ-পাতাল প্রভেদ লাগে । শিবু এত লোকের দেপাrদখি লখা-মাঝির সঙ্গে জলে নামিয়া পড়িল । স্বচ্ছ জলের তলায় নানা রঙের গুড়ি স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, খুশী হইয়া সে দুষ্ট হাতে তুলিতে লাগিল । কুধু একটি রজতগুল পাথরের বেীর উপর বসিয়া সাওতালমেয়েদেব জলক্রীড়া দেখিতে লাগিল । কলসীর পিছন দিক দিয়: অপরিস্কাৰ জল দূপে ঠেলিয় দিয় তাহার। নদীর রূপালি জলে কষ্টিপাথরের মত কালে মিটেল চিকুণ দেহ ভাসাইয়া তরল শুভ্র জল ; কঠিন কালে মূৰ্ত্তিব বিপরীত শোভায় বনভূমি স্বল্পক্ষণের জন্য আলো করিম এক এক কলসী জল লই য়ু ধরে ফিরিয়া চলিল । সধাকে দেখিয় সাওতাল-মেয়েদের কৌতহল অত্যন্ত পূজাগ হইয়! উঠিল, বার বার পিছন ফিরিয়া দেখিতে লাগিল । বাঙালী বধুরাও ঘোমটা সরাষ্টয়া সকৌতুক দৃষ্টিতে একটু মুকু হাসিয়া চলিয়া গেল। প্রৌঢ় দুই-এক জন জিজ্ঞাসা করিল, “ফুথ যাচ্ছ গোঁ ?" সুধা বলিল, “মানবাড়ী ।” “কুন গী, কত দূর ? ' স্বধা বলিল, “রতনজোড় ; সে অনেক দূর ।” হার্টুরে মেয়েরা স্নান সারিয়া উঠিতেই স্বধার মা মহামায়াকে দেখিয় তরিতরকারির ঝুড়ি লইয় অগ্রসর হইয় আসিল, “বেগুন লিবি গে, সিম লিবি গে ?" পথের মাঝে মাঝে ক্রেত দেখিলেই তাহার ছোটখাট হাট বসাইয়া দিতেছে । সময়ের কোনও মূল্য নাই, যতক্ষণ খুশী, যতবার খুশী জিনিষ বাছাই কর, ওজন কর, কেহ কিছু আপত্তি করিতেছে না । অলখ-বেণর Sפאסא মহামায়া বলিলেন, “আমার ত এথানে ঘর নয় বাছ, তরবারি নিয়ে কি করব ? ফল টল থাকে ত বরং দাও।” একজন বলিল, “কলা আছে, লিবি ?” আর একজন বলিল, “আতা আছে।” বৈরাগীর দলও হাটের সওদা দেখিয় ছুটিয়া আসিল । তাহারা চিড় কিনিতেই বেশী ব্যস্ত, দুই-এক জন মোট মোট শশাও কিনিল। মহামায় ছেলেমেয়েদের জন্ত কলা ও আতা কিনিলেন। একটা সিকি ফেলিয়া দিয়া দুইট পয়স চাহিতেই সকলে প্রায় সমস্বরে বলিয়া উঠিল, “উ নাই লিব ।” শিবু ততক্ষণ উঠিয়া আসিয়াছে ; সে সিকিটার উপর সাওতালদের সন্দিগ্রদূষ্টি দেখিয়া বলিল, “ম, সাওতালগুলো বড় বোকা, ওর পয়সা ছাড়া আর সব-কিছুকেই ভয় পায় । কুপোর সিকিরই ত বেশী দাম, তা নেবে ন! ” অনেক কষ্টে তাহদের দাম চুকাইয়া বিদায় করা গেল । কিন্তু লথ-মাঝি কুড়ান পাথরের উলুম জালিয় রান্ন স্বরু করিতেই আবার ভীড় স্বরু হইল। তখন চনচনে রোদ উঠিয়াছে, লোকগুলার মাথায় ছাতা কি একটুকরা গামছাও ংস্কৃত নাই, মাথার চুলই রোদ হইতে বাচাইবার একমাত্র উপায় । এততেও অনেকের বিড়ি খাওয়ার সখ পূরা আছে । সবাই বলে, “মাঝি, একটু আগুন ।” বেচার লখা কতবার যে উনানের কাঠ বাড়াইয়া ধরিল তাহার ঠিক নাই। শেষকালে একটা খড়ের কুড়িতে আগুন ধরাষ্টয় পাথরের পাশে ফেলিয় রাথিয় দিল, যাহার ইচ্ছা আপনি ধরাইবে । মহামায় বলিলেন, "বাছা, তাড়াতাড়ি রান্ন। খাওয়া সেরে নে, রোদ উঠেছে চড়চড়ে, তার উপর এই হাটের ভীড়, এখানে আর ব’সে থাকা যায় না ।” আবার যাত্র স্বরু হইল । নদী পার হইয়া মাঝে মাঝে উচু ডাঙ্গা জমির উপর ঝোপের মধ্যে কালে কালে হাতীর মত পাথর, মাঝে মাঝে ঘন সবুজ ধানের ক্ষেত। কোনও ক্ষেতে একটুখানি সোনার রং ধরিয়াছে, কোনটা একেবারে কাচা। দূরে দূরে বধের জলে অসংখ্য শালুক ফুল ফুটিয়া লালে লাল হইয়া উঠিয়াছে। গ্রাম্য পথের এমন উজ্জ্বল রূপ দেখিয়া সুধার মনটা ভরিয়া উঠিতেছিল। দুই চোখে দেখিয়াও আশা মিটে না। পৃথিবীটা কি আশ্চৰ্য্য মুন্দর ।
পাতা:প্রবাসী (ষট্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৪৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।