মহারাষ্ট্রে বর্ষা-উৎসব শ্ৰীঅমিতাকুমারী বস্তু সব দেশেই বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের বিশেষ বিশেষ আনন্দউৎসব আছে। মহারাষ্ট্র দেশের কোলাপুর রাজ্যে কৃষক-সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমনই এক উৎসব আছে, তার নাম “টেম্বলাবাঈল পানি।” আযাঢ় মাসে এদেশে বর্ষা আরম্ভ হয়। আষাঢ়ের মনস্কনের বাতাস সমুদ্র-গর্জনের মত ভীষণ গর্জন করে বেগে বইতে থাকে, আর থকে থম্কে বৃষ্টি পড়তে থাকে, হ্রদ-নদী, খাল-বিল জলে ভরে যেতে থাকে ; তখন এই কৃষকশ্রেণীর লোকের কল্পনায় তাদের শস্তক্ষেত্রগুলির শুশমল রূপ দেখতে পেয়ে আননো উৎফুল্ল হয়ে উঠে। বর্ষার নবজলধারায় দেবীকে অভিষিক্ত ক'রে তারা দেবীর আশীৰ্ব্বাদ চাইতে যায়। সেই সময়ই তাদের বর্ষা-উৎসব। কোলাপুর মহারাষ্ট্র অঞ্চলের একটি দেশী রাজ্য। এর প্রাকৃতিক শোভ বড়ই মনোহর। দুর্ভেদ্য শৈলরাজি পার হয়ে এই পাৰ্ব্বত্য রাজ্যে পৌছতে হয় । বাংল-মায়ের স্নিগ্ধ হ্যামল কোল ছেড়ে এসে মহারাষ্ট্রের এই বন্ধুর পাৰ্ব্বত্য শোভা দেখতে দেখতে মন বিস্ময়ে ভরে যায়। আম্বাবাঈ ও টেম্বলাবাঈ, এরা দু-বোন কোলাপুরের নগরদেবী। বড় বোন টেম্বলাবাঈ ও ছোট বোন আম্বাবাঈ প্রধান ও বিখ্যাত দেবী। ব্রাহ্মণরা বিশেষ ভক্তিভরে এদের পুজে ক’রে থাকে, নগরের মধ্যস্থলে আম্বাবাঙ্গর মন্দির মাথ৷ তুলে আছে। মন্দিরের কারুকার্য্য ও গঠন-নৈপুণ্য পুরাকালের ভারতবাসীর ভাস্কৰ্য্য ও স্থাপত্যবিদ্যার পরিচয় দেয়। শুধু কোলাপুরে নয়, সমগ্র দাক্ষিণাত্যেই আম্বাবাঈর মন্দির ধর্মের পীঠস্থান । টেম্বলাবাঈ সেরূপ প্রসিদ্ধ না হ'লেও কৃষক-সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবী। এক পাহাড়ের চুড়ায় টেম্বলাবাঈর মন্দির প্রতিষ্ঠিত। স্থানটি বড় সুন্দর ও নির্জন । হিন্দুদের দেবমন্দিরের স্থান-নিৰ্ব্বাচন সৰ্ব্বত্রই তাদের রুচির পরিচয় দেয়। অধিকাংশ স্থলেই দেবমন্দিরগুলি পাহাড়ের চূড়ায়, নয়ত অতি নির্জন স্থানে অবস্থিত। চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্ঘ্য ও নীরবত দর্শকের মনে গাম্ভীৰ্য্য এনে দেয়। তার পর মন্দিরের ভিতরের মৃদু আলোক, ধূপধুনোর গন্ধ, ফুলের সৌরভ, আলো-আঁধারের মধ্যে কালে পাথরের দেবদেবীর মূৰ্ত্তি এক রহস্তলোকের হুষ্টি করে। এখানে উত্তর-ভারতের মন্দিরগুলির মত পাণ্ডার উপদ্রব নেষ্ট । “টাকা দাও, পয়সা দাও, সুফল নাও" এসব ব’লে উৎপাত ক'রে দর্শকের অথবা পুণ্যকামী ভক্তদের মনে বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলবার লোক এখানে নেই। তাই এদেশের মন্দিরগুলি বেশ শাস্তিময় । এই টেম্বলাবাঈর মন্দির এত নির্জন যে সন্ধে হ'লেই সব জনপ্রাণী সে-আশ্রয় ছেড়ে চলে যায়। জনপ্রবাদ আছে যে, এই দেবী বড় জাগ্রত। রাত্রে জনহীন মন্দিরে কি হয়, সে-বিষয়ে সাধারণের কল্পনা বহু বিচিত্র প্রবাদের স্বষ্টি করেছে, যেমন, রাত্রে এখানে দেবীর লীলা হয়, ভূত, অপ্তারা প্রভৃতির আবির্ভাব হয়, দু-এক জন সেখানে লুকিয়ে থেকে ফ্লু-চোখ হারিয়েছে, নয়ত প্রাণে মারা গেছে, হত্যাদি । এদিকে আম্বাবাঈর মন্দিরের চার দিকে জনকোলাহল । ভোরে সাতটা থেকে রাত্রি দশটা অবধি মন্দিরের দ্বার অবারিত থাকে । সেখানে সারাদিন পুজো-অৰ্চনা সব চলতে থাকে, ভক্তের মন্দির-চত্বরে বসে সারাদিন সাধনভজন, শাস্ত্রপাঠ করতে থাকে। আম্বাবাঈর মন্দির সম্বন্ধে । এদের কোন ভীতিই নেই। বৎসরে একবার এই দু-বোনের সাক্ষাৎ হয়। আশ্বিন মাসে দুর্গাপূজার পঞ্চমী তিথি এই সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট আছে । সেদিন এ-রাজ্যে উৎসব । রাজবাড়ীতে স্থাপিত আম্বাবাঈ ও নগরের মধ্যে স্থাপিত আম্বাবাঈ দুজনের জন্য দুটি রুপের পাৰ বের করা হয়।
পাতা:প্রবাসী (ষট্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৬০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।