পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আষাঢ় দেখে অবাক হয়ে যেতেন । আমি জানি আমি অতর্কিতে আপনাকে অকারণে কঠিন আঘাত করেছি। আমার উপরে আপনার যে স্নেহ আছে তার মধ্যে ক্ষমাভিক্ষার অবসর আপনি রাখেন নি। তবু আমাকে...” শচীন বললে, “পাৰ্ব্বতী, আমি কি জানি না আমাৰে আঘাত করলে আমার চেয়ে বেদন তোমার অল্প লাগবে না ? তবু যদি তোমার ক্ষুদ্ধচিত্তে কোনদিন সামান্যমাত্র শাস্তিদান করতে পারি তবে নিজেকে ধন্য মনে করব।" এমন সময় ভোলানাথ সশন্ধে তাদের সাম্নের খড়খড়ির দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল । পাৰ্ব্বতী হাসিমুখেই জিজ্ঞাসা করলে, “কি ভোলাদ, লুকানো ধনরত্ব কি আবিষ্কার করলে ? আশা করি কুঠির সীয়েবরা যাবার সময় তাদের জমানে টাকাকড়ি কোথাও একটা পুতেটুতে রেপে গেছে, কি বল ?” কথাটা ভোলানাথের এতক্ষণ মনে হয় নি। সে এর পরিহাসটুকু বুঝতে না পেরে আগ্রহভরে বললে, “না দিদিমণি, তা ত থোর কথা মনে হয় নি। নিশ্চয়ই আছে কোথাও,— দেখতে হবে খুজে ।” পৰ্ব্বতী তার ছেলেমানুষের মত বিশ্বাস ও সরলতায় সমেহে হেসে বললে, “আচ্ছ এখন থাক । চল বাড়ীটা ভাল করে ঘুরে দেখে আসি।" বলে সে লঘুগতিতে ভোলানাথের সঙ্গে চলে গেল। যাবার সময় ফিরে বললে, “আম্বন না, মিঃ সিংহ, বাড়ীটা দেখে আসি।” পাৰ্ব্বতী যত শীঘ্র নিজেকে সংহত ক'রে নিয়ে ভোলানাথের সঙ্গে নিতান্ত সহজভাবে কথা স্বরু করলে, শচীন্দ্রের পুরুষমনের পক্ষে তা সম্ভব হয় নি। সে পাৰ্ব্বতীর এই আচরণকে অল্প বয়সের লঘুচিত্তত বলে মনে করে কোন যুক্তিতে জানি না, নিজেকে যেন অল্প একটুখানি দায়িত্ব থেকে মুক্ত বলে অনুভব করলে । ఆ আজি ক'দিন হ’ল কমলের জর ছেড়ে গিয়েছে। কিন্তু অসম্ভব দুৰ্ব্বলতায় উঠে বস্বার ক্ষমতা পর্যন্ত তার নেই। দীর্ঘ তিন সপ্তাহের মধ্যে একদিনও তার এমন পরিষ্কার জ্ঞান হয় নি যে সে তার নিজের অবস্থার কথা কিছুমাত্র বুঝতে মানুষের মন 4 ^రిgఫె পারে। ভালই হয়েছিল। যে দুরন্ত তাওবের মধ্যে দিয়ে তাকে জীবনের সম্পূর্ণ নূতন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করতে হ’ল, তার রোগব্লিষ্ট দুৰ্ব্বল মস্তিষ্ক ও দুৰ্ব্বলতর হৃৎপিণ্ড সেই বিপ্লবকারী চিন্তার আবেগ সহ করতে পারত না। নেচার পাকা নাস। ঠিক সময়েই সে তার সমস্ত দেহ্যন্ত্রের সম্পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা ক'রে তার রক্ষার উপায় করেছিল। নইলে রক্ষা পাওয়া সম্ভবই হ’ত না । তবু এই জরে একটা সৰ্ব্বনেশে ক্ষতি করে দিয়ে গেল তার । তার মন থেকে নামের স্মৃতি একেবারে লুপ্ত হয়ে গেল। কত চেষ্টা সে করেছে, তার বাড়ী, তার শ্বশুরবাড়ীর নাম মনে করতে ; তাতে পরিশ্রমে তাঁর দুৰ্ব্বল মস্তিষ্ক শ্রাস্ত হয়েছে। ডাক্তার, নন্দ ও পত্নীকে কিছুকালের জন্য এই অনুসন্ধান-চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিয়ে বলে গেলেন যে স্মৃতি ফেরাবার চেষ্টা জোর করে করতে গেলে হয়ত মস্তিষ্কের অধিকতর ক্ষতি হ’তে পারে । স্বাস্থ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই বিলুপ্ত স্মৃতি বরং হয়ত ফিরে আসতেও পারে । আজ সকালে শুয়ে শুয়ে জানল দিয়ে পাশের বাড়ীর চুণবালি-খসে-যাওয়া দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে তার কেবলই দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। এই চোখের জলে তার বেদনার পরিমাণ যেটুকু ছিল তার কতকটা তার নিজের প্রতি অসহায় করুণায় বাঙালী হিন্দুকন্যার স্বাভাবিক যে চিন্তা তারই আবেগে সে মনে মনে বলতে লাগল, “কোন দোষ ত আমি জেনে-শুনে করি নি ঠাকুর, তবে এই দুঃখিনীর দুঃখের উপরে কঠিনতর দুঃখ কেন দিলে। আর যে পারি না । উঃ, আজ কতদিন তাকে দেখি নি।” কিন্তু শান্তবিগলিত এই অশ্রধারায় ভগবান এবং এই গৃহবাসী পরিবারের প্রতি তার হৃদয়ের পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞতাও ছিল অনেকখানি । সেদিন রাত্রে এই বাড়ীতে এসে যে-আশ্রয় নিয়েছিল, সে-আশ্রয় যদি তার পূর্ব আশ্রয়ের অহরূপ অথবা তার চেয়েও সৰ্ব্বনাশের হত ! মনে করতেও তার সার! শরীর ঝিম্‌ঝিম্ করে উঠল। এমন সময় খোকাকে কোলে নিয়ে মালতী এক বাটি গরম দুধ হাতে ক'রে এসে উপস্থিত হ’ল। মেজের উপরে থোকাকে কোলে নিয়ে বসে বললে, “পারি নে বাপু তোমার ” |