680 নন্দলালের গৃহস্থ-মন তার নিজের অস্তনিহিত অস্বস্তিকে কোনো অশোভন অভিব্যক্তির উচ্ছ্বাসে সংসারে বাহত কোনো অশাস্তির কারণ ঘটতে দেয় নি বটে, কিন্তু তার অস্তরের সঙ্গে বাইরের এই নিয়ত বিরোধে তার চিত্ত ক্রমে অবসন্ন হয়ে পড়ছিল। তার কিছুদিন পূৰ্ব্বেকার প্রফুল্ল মনের উপর যে ছায়াপাত হ’তে স্থরু হয়েছিল, তার মুখে, তার কাজে, তার প্রত্যেকটি বাক্যে সে তার উপচয়মান ক্লাস্তি ধীরে ধীরে বিস্তার করেছিল । খেতে ব'সে নন্দ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত, অনেক কাজে তার পূর্বের মত স্থির অবধান আর ছিল না । ব্যবসায়ের গুরুতর বিষয়গুলির গুরুত্বও তার কাছে ক্রমে উপেক্ষণীয় হয়ে উঠছিল । তবু বিদ্রোহে ভীত, সমাজশাসনে অভ্যস্ত তার পোষমানা মন তার অস্তরের সংগ্রাম-চেষ্টাকে শিথিল না-হ'তে দিতে পণ করেছিল । কিন্তু সে যেম আর পেরে উঠছিল না । মালতীর অবস্থা অন্য রকম । সে সহজেই সরল সাদাসিধা মানুষ। তাদের অবস্থার উন্নতি তার কাছে পরম উপভোগ্য । এখন আর তাকে একলাই রাধা, বাসন-মাজা প্রভৃতি যাবতীয় কাজ করতে হয় না । চাকর-দাসী নিয়ে সে দস্তুরমত গৃহিণীপনার আনন্দেই যেন সকলের প্রতি প্রসন্ন। তা ছাড়া কমলের ছেলে তার অনেকখানি সময় অধিকার ক'রে থাকত । তাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে, তেল মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, থাইয়ে, গল্প ক’রে ঘুম পাড়িয়ে সে পরমানন্দে নিজেকে ব্যাপৃত রাখত। নন্দলাল বাড়ী ফিরলে তাকে থোকার গুণপনার গল্প ক’রে, তার জন্য প্রাত্যহিক ফরমায়েসের কৈফিয়ং নিয়ে, নন্দলালকে ব্যস্ত করে তুলত। নন্দলাল হেসে বলত, “অত ক’রে ছেলেকে আদর দিও না। ওকে মানুষ হ’তে দাও।” মালতী অত্যস্ত রাগ করে উত্তর দিত, “আহ ! আদর আবার কি ? ছেলেপিলেকে ভূত সাজিয়ে, না থেতে দিয়ে রাখলেই খুব মানুষ করা হবে, না ? তোমার আত ভাববার দরকার মেষ্ট— কালকে ওর জন্যে দম-দেওয়া মোটর গাড়ী একটা বড় দেখে এনে দিও দিখি নি।” নন্দলাল ক্লাস্তভাবে মুছ হেসে চুপ করে থাকত । ক্রমে মালতীর কাছেও যেন একটু একটু ধরা পড়তে লাগল। কি একটা বিস্মরণ হওয়ায় মালতী একদিন রাত্রে অসুযোগ করে বললে, “তুমি আজকাল বডড ভুলে যাওঁ । প্রবাসী SNeg\రి সেদিন জ্যোতিদিকে চিঠি লিখে দিলাম তোমায় ঠিকান লিখতে, তুমি জোছনার নাম দিয়ে এখানকার ঠিকানা লিখে দিয়েছ। জোছনা চিঠিটা খুলে বললে, ও মা একি ভাই, এ যে তোমার লেখা । ভাগ্যিস অন্য কোন ঠিকানায় পাঠাও নি। কি যে ভুল হয়েছে তোমার !” নন্দলাল কৌতুকের প্রয়াসে উদ্বিগ্ন মুখ ক'রে বললে, “বুডো হয়েছি তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ।" মালতী ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, “আর ন্যাকরা করতে হবে না, বুড়ো হয়েছেন ! ভীমরতির বয়স হয়েছে, না ?” কথাট চাপা পড়া সত্ত্বেও নন্দলাল নিজের অনবধানত দেখে লজ্জায় আশঙ্কায় অস্তরে অস্তরে শঙ্কিত হয়ে উঠল । নিজের প্রতি ক্রমে তার বিশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসছে । লোকালয়ে এই অবস্তায় থাকলে কোন দিন একটা হাস্যকর কিছু ক'রে ফেলাও অসম্ভব নয় । কি করে নিজেকে সংযুক্ত করতে পারে তার কথা ভাবতে ভাবতে ৭ে উন্মন: হয়ে পড়ল। তার মুথের উপর তার চিস্তার বিহ্বলতার ছায়। ঘনিয়ে উঠল । কথা বলতে বলতে মালতী তার মুথের দিকে চেয়ে একটু শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাস করলে, “তোমার কি শরীর ভাল নেই ? ' লণ্ঠনের ছায়া-আলোয় সে দেখলে নন্দলালের মুখ অসgর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে । মালতা তার কপলে হাত দিয়ে দেখলে, জামার ভিতর হাত গলিয়ে দেখলে—না জর নয় । কেমন একটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় তার বুকট ভরে উঠল । বললে, “শোধে চল ।” হাসির চেষ্টায়ু মুখট বিকৃত ক'রে নন্দ বললে, “পগল, কিছু হয় নি । বাইরে আমার এথম টের কাজ " “তোক কাজ,” ব’লে মালতা তাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে পীড়িত ছুর স্তু ছেলেটিকে মা ধেমন ক’রে শুইয়ে আরামের ব্যবস্থা ক’রে দেয়, তেমনি সযত্নে তাকে শুঠয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে তার চুলের মধ্যে আ৬ল বুলিয়ে দিতে লাগল । নন্দ যেন অগত্য মালতার হাতে নিজেকে সমর্পণ করলে এই ভাবে পড়ে রঙ্গল । বুক ফেটে কান্না আর চেপে রাখা যায় না, নন্দলালের এমনি মনে হ'তে লাগল । সে মনে মনে বলতে লাগল “দয়াময় এই দুৰ্ব্বলতা থেকে, এই নিষ্ঠুর বঞ্চণ থেকে, এই সৰ্ব্বনাশ থেকে আমায় রক্ষা কর । তুমি দিও না এই শাস্তিময়
পাতা:প্রবাসী (ষট্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৫০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।