পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭০২ স্থল তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে জাজিমে বসে আছেন। পাশে রয়েছে পীতপানীয়পূর্ণ পাত্র। কপি-পরিবৃত স্বগ্রীবের মত ঘিরে আছে তাকে মোসাহেবের দল। সামনে বসে এক জন বাইজী তীক্ষস্থরের ছোট হারমোনিয়ম বাজিয়ে গান করছে। হারমোনিয়মের আওয়াজের সঙ্গে তার গলার তীক্ষুভার প্রতিযোগিতা চলছে যেন, কে বেশী শ্রবণবিদারণ হতে পারে । তার বিশাল বপু গুরুভার গহনায় ভর, পরনে সেই ময়ুর-দেওয় ম্যাঞ্জেণ্ট রঙের শাড়ী । অন্তঃপুরে জমিদার-গৃহিণী তত ক্ষণ বধূদের উপর, দাসীদের উপর শাসন শেষ ক'রে শুতে গেছেন। মোসাহেবের দল তারও কিছু কম নয়। বেশীর ভাগ বিধব, যারা বহু বাক্যবাণ সহ তার অন্ন পরিপাক করে । সধবাও অনেকগুলি আছে, স্বামী যাদের গুলির আড়ায় দিন কটায়, পুত্রকন্যাদের সংখ্যা যাদের গণনাতীত। এ-সব আশ্রিতাদের মধ্যে একটা চাপ প্রতিযোগিতা আজীবন চলে, গৃহিণীর তেষামোদীতে কে অগ্রণী হ’তে পারে। গৃহিণীর অবহেলার অপমানে তারা অন্তরালে তার নিত্য মৃত্যুকামনা করে, সামনে তার কথায় দিনকে রাত বলে। গৃহিণীর বপুখানি বিশালতায় কৰ্ত্তাকে অন্তগমন করেছে। তার আশ্রিতার বলে, “রাণীমার সোনার অঙ্গ দিনে দিনে কাহিল হয়ে যাচ্ছে ।" এমন ক্ষীয়মান দেই পাছে একেবারে অদৃপ্ত হয়ে যায় এই ভয়ে তিনি নড়াচড়া করেন না। ডাক্তারে বলেছে বুক খারাপ, সেই জন্যে বধু ও দাসীদের তিরস্কার ছাড়া সংসারের কাজে কুটোটি নাড়েন না। মার্বণ-পাথরের মেঝেতে মখমলের আসন বিছিয়ে বসেন তিনি, আশ্রিতার দল কেউ পায়ে হাত বুলোয়, কেউ কেশবিরল মস্তকে তেল মাথায়, কেউ পাখা করে, কেউ বা কানে সড়সুড়ি দেয়, আর নবতর চাটুবাক্য উদ্ভাবনে তাকে পরিতুষ্ট করতে যায়। গৃহিণীর সারা অঙ্গ সেকালের নাইটুদের কোট অব আসস-এর মত নিরেট অলঙ্কারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। পরলে তার মূল্যবান একখানি মাত্র স্বশ্ব শান্তিপুরী শাড়ী। গ্রামের ভদ্রাসন বহুকাল হ’ল তারা পরিত্যাগ ক’রে এসেছেন । সেখানে কি মানুষ থাকতে পারে ? কলকাতার বিশাল বদ্ধ বাড়ী, ধুলায় ধোয়ায় মলিন হয়ে আছে । দেউড়িতে দরোয়ানদের খাটিয়া, দুগন্ধ কম্বল, ময়ল মাদুর, খইনির চণ, তামাকের ছাই ছড়িয়ে আছে সমস্ত জায়গায়। অন্তঃপুরের অঙ্গনে পঁচিশ বার গোবর-জলের ঝাট দেওয়া জঞ্জাল, তরকারির খোস, মাছের আঁশ, গরুর বিচালির ডাবা । এক পাশে অযত্নপালিত বড় বড় গরু বাধা,--গোবরে মাছিতে সেখানটা একেবারে ছেয়ে আছে। দাসী-চাকররা প্রচণ্ড হটগোলে সৰ্ব্বদা হাট বসিয়ে রেখেছে। ঘরের নান রকম নক্সাকাটা রঙীন দেওয়ালে আঙুলমোছা চুণের দাগ । প্রবণসী ১৩৪৩ মেঝেতে পানের পিচ,। পৈতৃক আমলের আসবাব ঘরে ঘরে দমবন্ধ ক'রে ঠাসা রয়েছে—প্রকাও প্রকাও আলমারি, সিড়ি-লাগান খাট, সিন্ধুক। সদরে বসবার ঘরে গালিচার ওপর পুরুষানুক্রমে ধুল জমে আছে, বড় বড় বাড়ির বেলোয়ারি ঝাড়ে মাকড়সার জাল নিদ্বন্দ্বে ঘন হচ্ছে । ভিকৃটোরিয়ান যুগের বিপুলায়তন সোফা চেয়ার, দেওয়ালে বৃহৎ ফ্রেমে বহুকাল-পরলোকগত রাজপুরুষদের ছবি, ধুলায় সব মলিন হয়ে আছে । গৃহিণীর পরিচালনা এত দূর পৌছয় না। একে তিনি অস্তঃপুরিক, তাতে তার হার্ট খারাপ। তিনি যখন ন-বছরের ক'নে হয়ে এ সংসারে এসেছিলেন, তখন বধূদের নিজেদের কক্ষ ছেড়ে বাহিরে আসা প্রথা ছিল না । তারা বসনভূষণ পেতেন, পুত্বলের মত সাজতেন, ঘরের মধ্যে ওঠাবসা করতেন, দাসীরা সমস্ত কাজ হাতে হাতে ক’রে দিত। বিনা পরিশ্রমে র্তাদের দেহ ক্রমে স্থল হ’তে স্থলতর হ’ত । কোন পালপাৰ্ব্বণে পালকি অন্তঃপুরে আসত, পালকিতে উঠে বসলে বাহকরা ঘেরাটোপ-ঘেরা পালকিল্পদ্ধ তাদের গঙ্গার ডুবিয়ে নিয়ে আসত। বাহিরের জগতের সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক তাদের ছিল না । কর্তাদের নানা আপত্তিকব অনুল্লেখযোগ্য জায়গায় যাওয়ার কথা তাদের কানেও পৌছত । কৰ্ত্তাদের পূর্বপুরুষের আমল হ'তে এসব চলেছে, এখনও চলছে । এর মধ্যে যে বীভৎসত আছে সেটা তাদের আত মনে লাগত না । ওসব হ'ল পুরুমমানুষের খেলার জিনিষ, বড়মাসূদীর অঙ্গ, ওতে কিছু আসে যায় না বলে নিজেদের সাত্বনা দিতেন । তাদের নিজেদের জীবনও খেলার পুতুলের চেয়ে কিছু উন্নত কি-না এসব চিস্ত। তাদের ধারণার বাইরে ছিল, কেউ এসব কথা কোনদিন তাদের শোনায়ওঁ নি। এখনকার বধূর কক্ষ দূরের কথা, গৃহ ছেড়ে সংসারের সীমানা পেরিধুে বাইরের কৰ্ম্মক্ষেত্রে গিয়ে দাড়ায়, পুরুষমাতুসের সমালোচনা করতে বসে, নিজেদের মতামত জাহির করতে চায় । এসব নিলাজ দুঃসাহসিকতায় গৃহিণী স্তম্ভিত হয়ে যান । তার সংসারে অবশু এসব হবার জে-টি নেই, তার হার্ট নিয়ে তিনি যত দিন বেঁচে আছেন । একরাশ টাকা ঢেলে মেয়ের বাপ মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বলেই দায় ফুরিয়েছে নাকি ?--মেয়ের বিয়ে দিয়ে তিনি যে আজীবন চোরের দায়ে ধরা পড়েছেন, গৃহিণী যত দিন আছেন এ-কথাটি তার বেহাইদের তুলতে দেবেন না । তার ছেলেরাও সে-বিষয়ে আদর্শ ছেলে, সেই যে মায়ের দাসী আনতে যাচ্ছি ব'লে বিয়ে করতে বেরিয়েছে তার পর থেকে বধূদের দাসীর মতই শাসনে রেখেছে । তারা মায়ের অাচলের নিধি, বড় আর হ’ল না । শিশুকাল হ’তে তারা বাক্সর আঙর, মাটিতে পা দিলে পচিশটা লোক ছুটে আসবে ই ই ক'রে, একটা