অণশ্বিন সেপনের সন্ধানে ^ఫిఁ বনহরিণীর সঙ্গে তুলনা করতেন। অথচ প্রতি রক্তকণায় সে নগরবাসিনী। তার ভাল লাগা বলে কোন জিনিষ নেই ; ভাল লাগলে হৃদয় থেকে সেই ভাব প্রকাশ কেমন ক’রে হতে পারে তা সে ভুলে গেছে। এই শ্রেণীর নারী নিজের বাহিরে আর কারও কথা সহজ ভাবে ভাবতে পারে না। আমার মনে হয়, ইউরোপের অবাধমিশ্রণের সমাজে, সকলের স্তুতিবাদরাস্ত রূপকে এই মূল্য দিতেই হবে। যদিও মেয়েটি রঙীন আকাশের তলায় ধূসর পাহাড়ের একটা স্থঙ্ক সৌন্দৰ্য্য দেখে বলে উঠছে, “কি সুন্দর, নয় কি”, যদিও সে এই লোকগুলির অদ্ভূত পোষাক ও মনোহর চলনভঙ্গী দেখে মৃদুস্বরে বলছে “কি অদ্ভুত, চমৎকার", তবু আমি জানি যে সে সেই বিরাট ও স্তন্ধ সৌন্দর্ঘ্যের মধ্যে নিজেকে একটু বাহিরের জগতের বলে মনে করছে। সে এই নিরুদ্দেশের আহ্বানময় দৃশ্বের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে নি, আর সে জন্য এই উদাস বৈরাগ্যের ধূসর চিত্রপটের সামনে তার উজ্জ্বল পোষাক, ফ্যাশনের চূড়ান্ত একটা স্থাটের পাশের পকেটে হাত রেখে অঙ্গ হেলিয়ে দাড়িয়ে থাকা, একটা প্রতিবাদের মত দেখাচ্ছে। সে যেন বুলভার-এ বেড়াতে এসেছে, সে পথিক নয়। তার চরিত্র হচ্ছে আত্মসচেতন, তার মনের জন্মভূমি প্যারিসের এক টুকরা, জীবনের মানদণ্ড ফ্যাশন। যেখানেই যাই এই রকম টুরিষ্টের সন্ধান পাই। ‘আমেরিকান টুরিষ্ট কথাটা একটা অবজ্ঞেয় সংজ্ঞ পেয়েছে। কিন্তু শুধু আমেরিকানরাই বা দোষী কেন ? বেশীর ভাগই বাহিরে বেড়াতে আসে ক্লাবে ও সমাজে নাম কিনবার জন্য, দলের মধ্যে দশ রকম কথা বলতে পারবার জন্ত । সবাই টুরিষ্ট এজেন্সী'র বিজ্ঞাপন ও গাইডের হাতে আত্মসমর্পণ করে বিনা প্রতিবাদে, চোখ না খুলেই, বিখ্যাত চিত্রশাল ও জম্ভশাল, রাজপ্রাসাদ ও ভূতুড়ে দুর্গ দেখে বড় হোটেলের বাধা ভোজ থেয়ে নিজের দলের বা সেই হোটেলের অন্যান্য ভ্রমণকারীর সঙ্গে থেকে নির্ভাবনায় সময় কাটিয়ে যায়। ইংরেজ ও আমেরিকান সব সময়ই ইংরেজী কথা বলা যায় এমন হোটেলে আস্তানা নেবে। এ-বিষয়ে বিদেশী সামান্তবিত্ত ছাত্র সৌভাগ্যবান। সে থাকবে দেশীয় হোটেলে বা কোন লোকের বাড়ীতে কাঞ্চন মূল্যে ; ভোজন তার নিজে আবিষ্কার করা পথপাক্টে রেস্তোরায়, পরিচয় অপরিচিতের সঙ্গে। আর সব বড় সৌভাগ্য যে সে নিজেকে ভুলতে বা ভোলাতে দেশভ্রমণে আসে না, আসে নিজেকে জাগাতে। ইউরোপ ও আমেরিকার পথের লোক অন্ত কোন কারণে না হ’লেও একটা বিশেষ মানসিক কারণে ভ্ৰমণকারী হতে বাধা। তারা নিজেদের ভুলতে চায়। সৌভাগ্যের অনিত্যতা, জীবনের লক্ষ্যহীনতা ও অনেক সময় উচ্চাকাঙ্ক্ষার নিবুদ্ধিত তাদের জীবনকে একটা উদেশ্বহীন, নিরবচ্ছিন্ন গতি দেয়। সেই গতির আবেগে এর মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হয়। স্পেনের শ্রেষ্ঠ সমুদ্র-বিলাসের স্থান সান সিবাষ্টিয়ানে বিস্কে উপসাগরের ব্রেকওয়াটারের পিছনের আচঞ্চল জলে সাগরক্ষান করতে করতে এই কথাই মনে হ'ল। সামনে সমূত্রের অসীম নীল নিদ্রাকরুণত, দুই পাশে আসামের মত বিটপীশোভিত পৰ্ব্বতশ্রেণীর খামশান্তি। এই দৃশ্বের মধ্যে ত ভ্রমণকারী দল নিজেদের মিলিয়ে দেয় না; কেহ হৈচৈ করে সমুত্ৰগ্নান করে, কেহ স্পেনের চমৎকার মোটর-পথে বহুদূর চলে যায়, কেহ সন্ধ্যায় হোটেলের বিস্তীর্ণ বিলাসলীলাময় নাচঘরে আত্মবিশ্বত থাকে। আত্মবিস্মরণের এই প্রাণপণ চেষ্টাই তাদের অনেকের উদ্দেশ্বহীন জীবনের উদ্দেশ্ব। নিজেকে বিস্তৃত হবার, চিন্তাকে বিক্ষিপ্ত করবার প্রবল তৃষ্ণায় তারা আনন্দের পর আনন্দের সম্ভারে দিনরাত্রি পূর্ণ রাখতে চায়। আজকাল উল্লাস ও উত্তেজনা না হ’লে চলে না, কারণ সকলেই গত মহাযুদ্ধের পর থেকে নিজের অসহায় ক্ষুদ্রতার কথা ভাবতে ভয় পায়। যা অনন্ত ও চিরন্তন তা ইউরোপে সান্ত ক্ষণস্থায়ী জীবনে এ-যুগে কোন আশ্বাসের বাণী দিতে পারছে না। কিন্তু এ আনন্দের অন্বেষণও কাউকে বেশী দিন তৃপ্ত রাখতে পারছে না, কারণ তা লঘু অগভীর ও বিরামহীন। ইউরোপের সব আনন্দের পণ্যশালাতেই একটা অতৃপ্তির ভাব দেখি যাকে ফরাসী ভাষায় বলে 'blnse', যাদের জীবনে এত গতি, এত উদামত তারাও নির্জন মুহূর্তে বলে উঠে—হাউ বোরিং ! \ు ডিসেম্বর মাসের প্রভাত বাহিরের তুষারের প্রতিফলি
পাতা:প্রবাসী (ষট্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৮৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।