অতি প্রাচীন কাল হইতেই ভারতবর্ষ বহুসংখ্যক খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বিভিন্ন যুগে প্রদেশ-ভেদে বিভিন্ন প্রকারের রাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত ছিল বলিয়া জানা যায়। কোথাও রাজতন্ত্র রাজ্য, কোথাও বা গণতন্ত্র, আবার কোথাও অল্পজনতন্ত্র অবলম্বিত হইত। কিন্তু উত্তরাপথের প্রদেশসমূহে রাজতন্ত্র রাজ্যেরই (monarchical form of Government) সমধিক প্রচলনের কথা ইতিহাস-পাঠে অবগত হওয়া যায়।
রাজতন্ত্র রাজ্যের নরপতি যখনই নিজের বাহুবল, মন্ত্রিগণের সূক্ষ্মবুদ্ধি ও প্রজাপুঞ্জের অনুরাগ,—এই তিন বস্তুর উপর যথাযথ ভাবে নির্ভর করিয়া প্রকৃত-দণ্ডধর রূপে খগুরাজ্যগুলিকে ঐক্য-সূত্রে বন্ধনপূর্ব্বক নিজের সার্ব্বভৌম রাজত্বের শাসনাধীন করিয়া রাখিতে পারিয়াছিলেন, তখনই তিনি সাম্রাজ্য গঠন করিয়া লইতে পারিয়াছেন। মৌর্য্য-বংশীয় চন্দ্রগুপ্ত, গুপ্ত-বংশীয় সমুদ্রগুপ্ত ও বর্দ্ধন-বংশীয় হর্ষবর্দ্ধন প্রভৃতি মহাশক্তিশালী নরপালগণ মিত্ররাজগণকে নিজ শক্তির অধীন রাখিয়া তাঁহাদিগকে সামন্তরাজরূপে স্ব-স্ব রাজ্য শাসন করিতে দিয়াছিলেন, এবং শত্রু নরপতিগণের উচ্ছেদ সাধন করিয়া তাঁহাদের রাজ্যগুলিকে আপন শাসনগণ্ডীর অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন। এই ভাবে তাঁহারা এক-একবার উত্তর-ভারতে বৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন সত্য, কিন্তু পরে নানা কারণে যখনই তৎ-তৎ সাম্রাজ্যের শেষ নরপতি নিজ সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে অসমর্থ হইয়াছেন, তখনই শাসন-শৃঙ্খল শিথিল হইয়া দেশকে পুনরায় স্ব-স্ব-প্রধান অসংখ্য ক্ষুদ্রায়তন রাজতন্ত্র-পদ্ধতিতে শাসিত খণ্ড খণ্ড রাজ্যে পরিণত করিতে সহায়তা করিয়াছে। তখন দেশে সর্ব্বতোভাবে বিপ্লব, বিগ্রহ ও অরাজকতা উপস্থিত হইয়া সমাজকে মাৎস্য-ন্যায়ের বশবর্ত্তী করিয়া তুলিয়াছে। তখন সমাজে দুর্ব্বলেরা সবলের কবলে পতিত হইয়া নানারূপ কষ্ট পাইয়াছে—তখন প্রভাব-উৎসাহ-মন্ত্রণা-শক্তিসম্পন্ন সার্ব্বভৌম নরপতির পদমর্য্যাদা লাভের উপযুক্ত পাত্র দেশে না থাকায় দণ্ডনীতি-শাস্ত্রের প্রধান প্রতিপাদ্য ‘দণ্ড’ বা শাসন অপ্রণীত থাকিয়া গিয়াছে।
ভারতবর্ষের পূর্ব্বাঞ্চলে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে হর্ষবর্দ্ধনের তিরোভাবের সঙ্গে সঙ্গে যখন ‘অর্ব্বাচীন’ গুপ্ত-বংশীয় নরপতিগণের রাজ্যও ক্রমশঃ মগধ দেশে বিলুপ্ত হইয়া পড়ে, তখনই গৌড়দেশে প্রায় সর্ব্বত্র মাৎস্যন্যায়-যুগ দেখা দেয়। সেই কালের বিপ্লব-যুগের অন্ধকার ভেদ করিয়া পাল-কুল-রবি গোপালদেব ‘প্রকৃতি’পুঞ্জের নির্ব্বাচনে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া পাল-সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানের হেতু-স্বরূপ ভারতের পূর্ব্বদিকে উদিত হন।
সকলেই জানেন যে প্রাচীন নীতিশাস্ত্রবিদ্গণের মতে রাজতন্ত্র রাজ্য ‘সপ্তাঙ্গ’ বা ‘সপ্তপ্রকৃতিক’ বলিয়া অভিহিত। এই সাতটি অঙ্গ বা প্রকৃতির নাম, যথা (১) স্বামী (বা রাজা), (২) অমাত্য (অর্থাৎ মন্ত্রী, সচিববর্গ, অধ্যক্ষবৃন্দ ও অন্যান্য রাজপাদোপজীবী কর্ম্মচারিগণ), (৩) সুহৃৎ (বা মিত্ররাজগণ), (৪) কোষ (রাজার কোষগৃহে সঞ্চিত ধনরত্নাদি ও নানারূপ আয়), (৫) রাষ্ট্র (বা জনপদস্থিত প্রজাসম্পৎ), (৬) দুর্গ (নগর ও দুর্গনিবাসী পৌরবর্গ), ও (৭) বল (বা দণ্ড অর্থাৎ চতুরঙ্গ সৈন্যবিভাগ)। রাজ্যের এই সাতটি অঙ্গের প্রত্যেকটি সুস্থ বা অবিকল না থাকিলে দেশের কল্যাণ নাই, কিন্তু তন্মধ্যে স্বামী বা রাজাকেই অন্যান্য অঙ্গ বা প্রকৃতির মূল স্বরূপ মনে করা হইত; অন্যান্য ছয়টি অঙ্গ বা প্রকৃতি সুসমৃদ্ধ থাকিলেও যদি ইহারা অস্বামিক থাকে, তাহা হইলে ইহাদের কার্য্যনিস্তার অসম্ভব হইয়া উঠে। বর্ত্তমান কালের আমলাতন্ত্র রাজ্যশাসনের ন্যায় অতি প্রাচীন কালেও নানা শ্রেণীর উচ্চ নীচ রাজকর্ম্মচারী দ্বারা নানাবিধ রাজকার্য্যের সম্পাদনবিধি প্রবর্ত্তিত ছিল। রাজতন্ত্র রাজ্যের কেন্দ্র হইলেন রাজা, কিন্তু তাহা হইলেও কৌটিল্য প্রভৃতি নীতিশাস্ত্রবিশারদগণ মনে করিতেন যে ‘রাজত্ব সহায়সাধ্য’। রাজার পক্ষে একাকী রাজ্যপরিচালন কোন প্রকারেই সম্ভাবিত নহে। কারণ, চক্রান্তর-সহায়-নিরপক্ষ কোন শকটাদি এক চক্রের বলে চলে না। কাজেই রাজাকে কর্ম্মসচিব ও মতিসচিবাদি নিযুক্ত করিতে হয়। মন্ত্রীদের মন্ত্রণ যে নরপতি শ্রবণ না করিয়া স্বমতেই অবস্থিত থাকেন, তাঁহাকে ভিন্নরাষ্ট্র হইতে হয়—তাই, কৌটিল্য লিখিয়াছেন—“সহায়সাধ্যং রাজত্বং চক্রমেকং ন বর্ত্ততে। কুর্ব্বীত সচিবাংস্তস্মাৎ তেষাং চ শৃণুয়ান্মতম্।” রাজার পক্ষে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিলে রাজ্যে অনর্থ উপস্থিত হয়—“প্রভুঃ স্বাতন্ত্র্যমাপন্নো হ্যনর্থায়ৈব