পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আশ্বিন
পাল-সাম্রাজ্যের শাসন-প্রণালী
৮৮৩

কল্পতে”—শুক্রাচার্য্যের এই মহানীতিবাক্য পাল-রাজারা যেন সর্ব্বদাই স্মরণ রাখিয়া চলিয়াছিলেন, বিশেষতঃ তাঁহাদের রাজ্যের প্রথম পঞ্চনরপালের যুগে। কারণ, তাঁহার নিজেরা সৌগত বা বৌদ্ধ হইলেও কুলক্রমাগত ব্রাহ্মণ-বংশীয় মন্ত্রিগণের মন্ত্রণাবলেই রাজ্য শাসন করিতেন, এই ঐতিহাসিক তথ্য আমরা ভট্টগুরব মিশ্রের বাদলস্তম্ভলিপি হইতে বিশেষ ভাবে জানিতে পারি। যদিও রাজতন্ত্র রাজ্যে প্রায় সর্ব্বপ্রকার শাসন সম্বন্ধে রাজাই একরূপ সর্ব্বময় কর্ত্তা ছিলেন, তথাপি তিনি এই গুরুতর কার্য্যে স্বাতন্ত্র্য-বশে কখনই স্বমতাবলম্বী হইয়া চলিতেন না। প্রাচীন ভারতে মন্ত্রী ও অন্যান্য সচিবেরাই যেন রাজার মন্ত্রীপরিষদে প্রজাপক্ষের অনির্ব্বাচিত প্রতিনিধি হইয়া রাজকার্য্য করিতেন। রাজারা তাই প্রজাশক্তি স্মরণ রাখিয়া মন্ত্রীদিগকে সম্মানের চক্ষুতে দেখিতেন। মন্ত্রী ও অন্যান্য অমাত্য নির্ব্বাচন সম্বন্ধে পালরাজারা জাতিকুল গণনা না করিয়া গুণগণনার উপরই নির্ভর করিতেন। তাই ধর্ম্মপাল প্রভৃতি প্রথম যুগের নরপাল-পঞ্চক শাণ্ডিল্য-বংশের কুলক্রমাগত মন্ত্রী গর্গ, দর্ভপাণি, কেদারমিশ্র ও ভট্টগুরবকে প্রধান মন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করিয়া রাজ্য শাসন করিয়াছিলেন। এই মন্ত্রীরা নীতিশাস্ত্রজ্ঞ অমাত্য-গুণ-সম্পদে আঢ্য ছিলেন বলিয়া ধর্ম্মপাল ও দেবপালের মত রাজগুণসম্পন্ন নরপতিদিগেরও অতি শ্রদ্ধার পাত্র হইয়াছিলেন। দেবমন্ত্রী বৃহস্পতি ইন্দ্রকে কেবল পূর্ব্বদিকের অধিপতি করিতে পারিয়াছিলেন, কিন্তু গর্গের বুদ্ধি এতখানি তীক্ষ্ণ ছিল যে তিনি ধর্ম্মপালকে অখিল-দিগের ‘স্বামী’ করিয়া দিতে সমর্থ হইয়াছিলেন বলিয়া বৃহস্পতিকে উপহাস করিতে পারিতেন। কান্যকুব্জাধিপতি ইন্দ্রায়ুধকে পরাভূত করিয়া ধর্ম্মপাল চক্রায়ুধকে কান্যকুব্জের সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন এবং তাঁহার এই বিজয়বার্ত্তায় ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তী, গন্ধার এবং কীর প্রভৃতি বিভিন্ন প্রদেশের রাজগণ প্রণতি-পরায়ণ মস্তকে তাঁহাকে সাধুবাদ প্রদান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত গৌরবময় ক্রিয়ার জন্য ধর্ম্মপাল নিশ্চিতই মন্ত্রী গর্গের মন্ত্রণ-কৌশলের উপর নির্ভর করিতেন। যাঁহার নীতির বলে দেবপাল প্রায় সমগ্র উত্তরাপথকে ‘করদ’ ভূমিতে পরিণত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন (“নীত্যা যস্য ভুবং চকার করদাং শ্রীদেবপালো নৃপঃ”), যাঁহার দ্বারদেশে রাজা স্বয়ং অবসরের অপেক্ষায় দণ্ডায়মান থাকিতেন এবং যাঁহাকে অগ্রে আসন প্রদান করিয়া পরে তিনি নিজে সচকিতভাবে সিংহাসনে উপবেশন করিতেন—সেই নীতিবিৎ মন্ত্রীর নাম দর্ভপাণি। চতুর্বিদ্যাবিশারদ্ মন্ত্রী কেদারমিশ্রের বুদ্ধির উপাসনা করিয়াই গৌড়েশ্বর উৎকলে, হূণ-রাজ্যে এবং দ্রাবিড় ও গুর্জ্জর প্রদেশে স্বশক্তি জ্ঞাপিত করিতে পারিয়াছিলেন। এই বৃহস্পতি-প্রতিকৃতি কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে, রাজা শূরপাল বৌদ্ধ হইয়াও স্বয়ং উপস্থিত হইয়া রাজ্যের কল্যাণ-কামনায় মন্ত্রীর যঞ্জীয় শান্তি-জল সশ্রদ্ধভাবে স্বমস্তকে গ্রহণ করিতে দ্বিধাবোধ করিতেন না। আবার নারায়ণপালের বহুমানের আস্পদ ছিলেন তদীয় নীতিপরায়ণ মন্ত্রী গুরবমিশ্র—এই মন্ত্রীতে লক্ষ্মী ও সরস্বতী যেন নিজ নিজ নৈসর্গিক বৈরভাব পরিত্যাগ করিয়া একত্র বাস করিতেন। আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, এই মন্ত্রী যেমন বিদ্বানদিগের সভাতে নিজের বিদ্যাবলে প্রতিপক্ষবাদীর মদগর্ব্ব খর্ব্ব করিতে পারিতেন, তেমনই আবার যুদ্ধক্ষেত্রে স্বপরাক্রমে প্রতিপক্ষ ভট্টগণের অভিমানও দূর করিতে পারিতেন। ব্রাহ্মণমন্ত্রীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরাক্রম-প্রদর্শনের কথা অসত্য বলিয়া গৃহীত হওয়ার যোগ্য নহে, কারণ এই পাল-বংশের পঞ্চদশ নরপতি কুমারপালদেবের ব্রাহ্মণ-মন্ত্রী বৈদ্যদেব যে রাজার পক্ষ হইতে অগ্রসর হইয়া কামরূপের বিকৃতিপরায়ণ নরপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া পাল-নৃপতি কর্ত্তৃক তত্রত্য রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, ইহা বৈদ্যদেবের কমৌলিতে প্রাপ্ত তাম্রশাসন হইতে লব্ধ একটি ঐতিহাসিক তথ্য। সেই লিপিতে বর্ণিত হইয়াছে যে গৌড়াধিপ কুমারপালের ‘সপ্তাঙ্গ ক্ষিতিপাধিপত্ব’-সম্বন্ধে সর্ব্বদাই চিন্তা করিতেন বলিয়া গুণিগণাগ্রণী ‘উগ্রধী’ তদীয় সচিব বৈদ্যদেব রাজার নিকট তাঁহার প্রাণাপেক্ষাও প্রিয়তর বন্ধু ছিলেন (“সপ্তাঙ্গক্ষিতিপাধিপত্বমভিতঃ সংচিন্তয়নুগ্রধীঃ প্রাণেভ্যোপাতিবন্ধুরস্য সচিবঃ সোঽভূদ্‌গুণিগ্রামনীঃ”)। পাল-রাজ্য শাসনে মন্ত্রীদের স্থান অত্যন্ত গৌরবময় ও উচ্চ ছিল বলিয়া এস্থানে তাঁহাদের সম্বন্ধে এতখানি বলা হইল। রাজতন্ত্র রাজ্যের অমাত্য ও কর্ম্মচারী বা আমলাগণ যুগে যুগে নাম ও কর্ত্তব্য সম্বন্ধে কি প্রকার পরিবর্ত্তন লাভ করিয়াছে