পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
আশ্বিন
পাল-সাম্রাজ্যের শাসন-প্রণালী
৮৮৫

 জ্যেষ্ঠকায়স্থ—মনে হয় রাজাধিকরণে যিনি লেখকশ্রেষ্ঠ তিনিই ‘জ্যেষ্ঠকায়স্থ’ বা ‘প্রথম কায়স্থ’ বলিয়া পরিজ্ঞাত ছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ বর্ত্তমান চীফ সেক্রেটারীর মত পদধারী ছিলেন।

 মহত্তর ও মহামহত্তর—গ্রামে যাহারা সমৃদ্ধ অবস্থার লোক ও সমাজে যাহাদের বেশ প্রতিপত্তি এবং গ্রামের ও নগরের লোকজন যাঁহার কথার বাধ্য—সম্ভবতঃ তাহারাই ‘মহত্তর’ (মাতব্বর) বলিয়া খ্যাত। তন্মধ্যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ যিনি তিনিই ‘মহামত্তর’ ও ‘মহত্তমোত্তম’। শেষোক্ত লোকদিগের সাহায্য লইয়া বিষয়পতিগণ বিষয়ের শাসনকার্য্য সম্পাদন করিতেন এই জন্য তাঁহারা ‘বিষয়-ব্যবহারী’ বলিয়াও তাম্রশাসনে উল্লিখিত হইয়াছেন।

 ক্ষেত্রপ—রাষ্ট্রে যাহারা ক্ষেত্রকর—তাহাদের মধ্যে কাহার কিয়ৎ-পরিমাণ ক্ষেত্রভূমি রহিয়াছে সে-বিষয়ে যিনি রাজাধিকরণে হিসাবরক্ষক, তিনি ‘ক্ষেত্রপ’ রাজপুরুষ।

 খণ্ডরক্ষ—রাজনিকেতন ও অন্যান্য রাজকীয় প্রাসাদ ও কর্ম্মান্ত-প্রদেশের এবং রাজ্যস্থিত মন্দির ও বিহারাদির খণ্ডস্ফুটিত-সমাধানে ও জীর্ণোদ্ধারকার্য্যে যিনি ব্যাপৃত থাকতেন, সেই রাজপুরুষের নাম ‘খণ্ডরক্ষ’ হইয়া থাকিবে। তিনি আজকালকার P.W.D. engineer প্রভৃতির সহিত তুলিত হইতে পারেন বলিয়া মনে হয়।

 দাশাপরাধিক—গ্রামবাগিগণের মধ্যে যাহারা শাস্ত্রোক্ত দশ প্রকার উৎকট দোষ বা অপরাধ করিত তাহাদের সেই অপরাধের শাস্তির জন্য রাজার যে ‘দণ্ড’ বা জরিমানারূপ অর্থ প্রাপ্য হইত, তাহার নামই ‘দশাপরাধ’ ‘দশাপচার’ দণ্ড। এই ‘দণ্ড’ বিধান, অথবা, এই টাকা-সংগ্রহ-কার্য্য যে রাজপুরুষের উপর ন্যস্ত থাকিত তিনিই ছিলেন ‘দাশাপরাধিক’।

 শৌল্মিক—শৌল্মিক বা শুল্কাধ্যক্ষ প্রাচীন রাজনীতি-শাস্ত্রে বর্ণিত এক জন প্রধান রাজপুরুষ। রাষ্ট্রের সর্ব্বত্র যাহারা পণ্যবাহী বণিক্‌গণ হইতে রাজার প্রাপ্য শুল্ক (customs ও tolls) আদায় করে—তাহাদের উপর অধ্যক্ষতার কাজ যিনি করেন, তিনিই শৌল্মিক। কোন্ পণ্য সশুল্ক রাজ্যসীমান্ত পার হয়—কোন্ পণ্য উচ্ছুল্ক হইয়া চলে—তদ্বিষয়ে সব বিধান তিনিই করিতেন। কোন্ দ্রব্যের উপর কত হারে শুল্ক বসিবে তাহাও নির্দ্ধারণ করিবার ভার থাকিত এই রাজকর্ম্মচারীর উপর। ইঁহার তত্ত্বাবধানেই রাষ্ট্রের পীড়াকর ভাণ্ড কখনই রাজ্যে প্রবেশ লাভ করিতে দেওয়া হইত না এবং মহোপকারী দ্রব্য উচ্ছুল্ক হইয়া প্রবেশলাভ করিতে পারিত। নিষ্ক্রাম্য শুল্ক (export duty) ও প্রবেশ শুল্ক (import duty) ও অন্যান্য বাহ্য আভ্যন্তর ও আতিথ্য নামক শুল্ক প্রভৃতির ব্যবহার এই রাজপুরুষের আয়ত্ত ছিল। শুল্কদানে ত্রুটি হইলে যে ‘অত্যয়’ বা জরিমানা হইত ইহার প্রত্যবেক্ষণও এই কর্ম্মচারীই করিতেন।

 চৌরোদ্ধরণিক—‘চোররজ্জু’ বা ‘চৌরদ্ধরণ’ নামে যে চৌকীদারী কর তৎকালে প্রচলিত ছিল, তৎসংগ্রহকারীদিগের ঊর্দ্ধতন রাজপুরুষের নাম ‘চৌরোদ্ধরণিক’। কেহ কেহ এই কর্ম্মচারীকে পুলিস বিভাগের রাজপুরুষ-বিশেষ মনে করেন, কিন্তু ইহা সঙ্গত মনে হয় না।

 মহাক্ষপটলিক—রাজকীয় ‘অক্ষপটল’ বা মহাপেজখানার যিনি অধ্যক্ষ পূর্ব্বে তাঁহার নাম ছিল ‘অক্ষপটলাধ্যক্ষ’। এই রাজকর্ম্মচারীর কার্য্যসদনে সর্ব্বপ্রকার নিবন্ধ পুস্তক (ledgers) থাকিত। গণনকার্য্যে নিযুক্ত ‘গাণনিক’ নামে আখ্যাত কর্ম্মচারীরা এই প্রধান রাজপুরুষের অধীন হইয়া কার্য্য করিত। গুপ্ত-যুগে যাহাদিগকে ‘পুস্তপাল’ নামে পরিচিত দেখিতে পাওয়া যায়, তাহারাও এই শ্রেণীর কর্ম্মচারী। রাজার সর্ব্বপ্রকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব এই ব্যক্তির কার্য্যাগারে বা আপিসে রক্ষিত হইত। এখানে যাঁহারা ছোট ছোট কাজ করিতেন তাঁহাদের কাহারও নাম ছিল ‘কার্ম্মিক’ ও কাহারও নাম ছিল ‘কারণিক’। এই রাজপুরুষের ব্যাপার বর্ত্তমান সময়ের একাউনটেণ্ট-জেনার‍্যালের কর্ত্তব্যের সহিত তুলনীয়।

সৈন্য বিভাগ

 সেনাপতি—তিনি চতুরঙ্গ সেনার, অর্থাৎ হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতির নায়করূপে কার্য্য করেন। হস্ত্যধ্যক্ষ বা হস্তিব্যাপৃতক, অশ্বব্যাপৃতক, পত্তিব্যাপৃতক প্রভৃতির অবেক্ষণ কার্য্যের ভার এই মহামাত্যের বা মহামাত্রের উপর ন্যস্ত থাকিত। এই সেনাপতিকে সর্ব্বপ্রকার যুদ্ধবিদ্যা ও প্রহরণবিদ্যায় শিক্ষিত হইতে হইত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে লিখিত আছে যে পত্তির অধ্যক্ষকে নিম্নযুদ্ধ, স্থলযুদ্ধ, প্রকাশযুদ্ধ, কূটযুদ্ধ, খনকযুদ্ধ (ট্রেঞ্চ কাটিয়া যুদ্ধ), আকাশযুদ্ধ, দিবাযুদ্ধ, রাত্রিযুদ্ধ প্রভৃতির জন্য ব্যায়াম (বা manœuvres) শিক্ষা করিতে হইত। সেনার ব্যায়ামের ভূমি, যুদ্ধের উপযুক্ত কাল, শত্রুসেনা অভিন্ন থাকিলে ভিন্ন করা, ভিন্ন স্বসৈন্যকে সংহত করা, সংহত সেনাকে ভিন্ন করা, বিঘটিত সেনার বধ, দুর্গ ধ্বংস, সেনার যাত্রাকাল প্রভৃতি বিষয়ে এই অমাত্যের সম্যক্ জ্ঞান থাকা চাই। সেনা-বিভাগের অত্যুচ্চ রাজপুরুষকেই সেনাপতি বা মহাসনাপতি বলা হইত।

 প্রান্তপাল—রাজ্যের প্রান্ত বা অন্ত (Frontier) প্রদেশ যাহার অবেক্ষণে থাকিত, সেই রাজপুরুষের নাম প্রান্তপাল।