পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৮৮৮
প্রবাসী
১৩৪৩

নিকট অনুনয়-সহকারে নিবেদন করিতেন—তাহাকে তাম্রশাসনের ‘দূতক’ বলা হইত। রাজপুত্র বা সান্ধিবিগ্রহিক বা অন্য কোন প্রধান অমাত্য এই কার্য্যে ব্রতী হইতে পারিতেন। যুবরাজ ত্রিভুবনপাল ধর্ম্মপালদেবের নিকট, যুবরাজ রাজ্যপাল ও মহামন্ত্রী ভট্টগুরব দেবপালের নিকট, মন্ত্রী ভট্টবামন প্রথম-মহীপালের নিকট এবং সন্ধিবিগ্রহিক ভীমদেব মদনপালদেবের নিকট কোন কোন তাম্রশাসন সম্পাদনকালে দূতকের কার্য্য করিয়াছিলেন বলিয়া ইতিহাস-পাঠে অবগত হওয়া যায়।

 রাণক, রাজন্যক, রাজরাজনক, রাজরাজন্যক—তাম্রশাসনে যাঁহাদের উপাধি ‘রাজন্যক’, ‘রাণক’ কিংবা ‘রাজরাজনক’ অথবা ‘রাজরাজন্যক’—তাঁহারা সামন্তরাজ-শ্রেণীভুক্ত নরপতি বলিয়া প্রতিভাত হয়।

 মহাসামন্ত, মহাসামন্তাধিপতি—আমার মনে হয় যে এই ব্যক্তিকে সামন্তরাজগণের মধ্যে প্রধান নরপতি মনে করা সঙ্গত হইবে না। সামন্তরাজগণ সম্বন্ধে রাজকুলে যে অমাত্য রাজগণকে নানাপ্রকার রাজনীতিবিষয়ক উপদেশাদি দিতে পারিতেন এবং সামন্তগণ সম্বন্ধে যত প্রকার সংবাদ জানিয়া রাখা দরকার তাহা যিনি রাখিতেন তিনিই এই নামে অভিহিত হইতেন। তিনি এক জন বিশিষ্ট রাজকর্ম্মচারী।

 রাজামাত্য—রাষ্ট্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে রাজাকে উপদেশ ও পরামর্শ যাঁহারা দিতেন সেই সকল কর্ম্মসচিব ও বুদ্ধিসচিব এই শব্দদ্বারা সূচিত হইতেন। তন্মধ্যে পঞ্চাঙ্গমন্ত্রে যিনি সম্যক্ অভিজ্ঞ খাকিয়া রাজার প্রধান মন্ত্রিপদে প্রতিষ্ঠিত থাকিতেন তিনি ছিলেন মহামন্ত্রী।

 রাজস্থানীয়োপরিক—গুপ্ত-যুগে যাঁহারা বড় বড় ভুক্তিতে ‘মহারাজ’ উপাধি-সহকারে সম্রাট্ কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইয়া রাজার স্থানভুক্ত বা রাজপ্রতিনিধি (viceroy) ভাবে (বর্ত্তমান গভর্ণরগণের ন্যায়) রাজ্যশাসন করিতেন তাঁহাদের আখ্যা ছিল ‘উপরিক’। মনে হয় পাল-সাম্রাজ্যে সেই প্রকার ভুক্তিশাসকগণই ‘রাজস্থানীয়োপরিক’ বলিয়া পরিচিত ছিলেন।

 মহাকুমারামাত্য—গুপ্ত-যুগে ‘কুমারামাত্য’ শব্দটিকে কখনও কখনও সান্ধিবিগ্রহিক, দণ্ডনায়ক, মহামন্ত্রী প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ রাজপুরুষগণও উপাধিরূপে ব্যবহার করিতেন। তখন পুণ্ড্রবর্দ্ধনভুক্তিতে অবস্থিত ‘বিষয়পতি’গণও এই উপাধি ব্যবহার করিতেন। মনে হয়, যাহারা বংশানুক্রমে (নিজদিগের কুমার-অবস্থা হইতে) অমাত্যপদলাঞ্ছিত ছিলেন তাঁহারাই ‘কুমারামাত্য’। কেহ কেহ ব্যাখ্যা করেন, যে যাঁহারা রাজকুমারদিগের অমাত্য-কার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকেন, তাঁহারাই এই শব্দদ্বারা সূচিত হইয়া থাকেন।

 মহাকার্ত্তাকৃতিক—এই রাজপুরুষের নিয়োগ সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয় না। এই শব্দটি ‘কর্ত্তৃকৃৎ’, অর্থাৎ যিনি কোন কার্য্যবিভাগের কর্ত্তাকে নিযুক্ত করিতে অধিকারী তাঁহাকে বুঝাইবার জন্য ব্যবহৃত হইত কি? যে রাজপুরুষ ‘কর্ত্তৃকৃৎ’ (officer-makers) সমূহের নিয়োগে শ্রেষ্ঠ অধিকারী, তিনি কি এই পদবাচ্য হইয়া থাকিবেন? প্রধান প্রধান আরব্ধ রাজকার্য্যের কতখানি পরিমাণ ‘কৃত’ হইল, বা ‘অকৃত’ রহিল তিনি কি তাহার তত্ত্বাবধানকারী কোন কর্ম্মচারীও হইতে পারেন?

 রাজপুত্র—রাজকুলের যাঁহারা যুবরাজ, বা রাজার অন্যান্য পুত্র কিংবা রাজসম্পর্কীয় অন্যান্য স্ববংশীয়গণ, তাঁহারাই এই শব্দদ্বারা সূচিত হইয়া থাকেন। যুবরাজ যে প্রাচীন রাজনীতিশাস্ত্রে অষ্টাদশ তীর্থের অন্যতম বলিয়া গৃহীত তাহা সুবিদিত। যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া তিনি পিতার সাহায্যার্থে অনেক রাজকীয় কার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকেন। পাল-সাম্রাজ্যে যুবরাজের প্রভাব প্রবল ছিল। কামন্দকনীতিশাস্ত্রে বলা হইয়াছে যে [“অমাত্যো যুবরাজশ্চ ভুজাবেতৌ মহীপতেঃ” (১৮–২৮)] অমাত্য ও যুবরাজ রাজার দুই বাহুসদৃশ্য।

 মহাদৌঃসাধ-সাধনিক, (পরবর্ত্তী কালে) দৌঃসাধনিক বা দৌঃসাধ্যসাধনিক বা দৌঃসাধিক—ষে রাজপুরুষের উপর দ্বারপালগণের অবেক্ষণ কার্য্য অর্পিত, তিনিই কি এই পদবাচ্য? কাহারও মতে তিনি গ্রামপরিদর্শকরূপে রাজকার্য্য করিতেন। আমার মনে হয়—যাহারা রাজাকে ‘বিষ্টি’ বা শ্রমদ্বারা সহায়তা করিত অর্থাৎ রাজকর নগদ বা দ্রব্যদ্বারা দিতে না পারিয়া হাতে খাটিয়া শোধ দিত সেই সমস্ত শ্রমজীবী কর্ম্মকরগণের উপর তত্ত্বাবধান কার্য্যে এই কর্ম্মচারী নিযুক্ত থাকিতেন।

 দূতপ্রৈষণিক (দূতপ্রেষণিক)—যে রাজপুরুষ অন্যান্য রাষ্ট্রে দূতপ্রেরণ-কার্য্যে নিযুক্ত থাকিতেন, তাঁহার নাম ‘দূত-প্রৈষণিক’ ছিল। দূত বিভাগ যে কত বড় প্রয়োজনীয় বিভাগ তাহা প্রাচীন অর্থশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্র হইতে পরিজ্ঞাত হওয়া যায়। পালশাসনযুগে সুদুর সুবর্ণদ্বীপ (সুমাত্রা) ও যবদ্বীপ প্রভৃতি প্রশান্ত-মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত রাজগণের সহিত ভারতের উত্তর-পূর্ব্বাঞ্চলের গৌড়াধিপগণের সহিত দূতযোগে নানা কার্য্যের সম্পাদন হইত। দেবপালের নালন্দালিপি হইতে অবগত হওয়া গিয়াছে যে শৈলেন্দ্র বংশতিলক যবভূমিপাল সমরাগ্রবীরের পুত্র, সুবর্ণদ্বীপাধিপতি মহারাজ বলপুত্র-দেব দূতকমুখে দেবপালের নিকট হইতে পাঁচটি গ্রাম তাম্রশাসনদ্বারা চাহিয়া লইয়া তাহা, নালন্দাতে তিনি যে বুদ্ধভট্টারকের বিহার নির্ম্মাণ করাইয়াছিলেন তাহাতে, সর্ব্বপ্রকার পূজাদি বিধানের জন্য প্রতিপাদন করিয়াছিলেন।