পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪র্থ সংখ্যা ] জীবনে সে মুহূৰ্ত্ত না আসিতে পারে। পথিক মানবের পথ চলাই পথের সমাপ্তি নহে। সঙ্কীর্ণ মন দিনে দিনে প্রসার লাভ করিতেছে। একদিন সে নিঃশেষে সম্পূর্ণ অপরিচিতের হাতে আপনার সর্বস্ব বিলাইয়া দিয়া বিগত দিনের দুঃখযন্ত্রণ ভুলিয়া ভাবিবে, পথের সন্ধান মিলিয়াছে।” তাহারও বুঝি পথের সন্ধান মিলিবে । ললিত স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া মঙ্গলাকে ডাকিয়া একটি বিখ্যাত পাবলিশাস-এর নামে চিঠি দিয়া তাহার প্রথম উপন্যাসখানি পাঠাইয়া দিল। চিঠিতে লিখিল— বইখানি পছন্দ হইলে তাহার প্রথম সংস্করণের জন্য যে কিছু মূল্য নিৰ্দ্ধারণ করেন তাহা যেন কল্যই তাহার ঠিকানায় পাঠাইয়া দেন।– মঙ্গল ফিরিয়া আসিল । ললিত কম্পিত চিত্ত লইয় প্রতীক্ষা করিতে লাগিল । যদি না মনোনীত হয় ?—না, তাহার এত পরিশ্রমের ফল কখনই ব্যর্থ হইবে না। পরদিন সুসংবাদ আসিল। বইখানি পছন্দ হইয়াছে। প্রকাশক প্রথম সংস্করণের জন্য পাঁচ শত টাকার চেক পাঠাইয়াছেন। এতদিনের আকাঙ্ক্ষিত জয়শ্রী তাঙ্গর মুখে একটু শীর্ণ হাসি টানিয়া অনিল মাত্র। পরদিন সকাল-বেলায় মেয়েটি আসিল । আসন্ন ঝড়ের ভয়ে মুখ বিবৰ্ণ ; শরীর কঁাপিতেছে। আদালতের লোক আসিয়াছে। ললিত হাত বাড়াইয়৷ চেকখানি তাহার হাতে দিল । সে ছলছল চোখে ললিতের হাত দুইটি চাপিয়া ধরিল মাত্র। কোনো কথাই বলিতে পারিল না । তারপর দ্রুত নীচে নামিয়া গেল । ললিতের *ে থা সার্থক হইল । ইহার চেয়ে অধিক কিছু সে প্রত্যাশা করে নাই । ভগবান তাহার পরিশ্রমের অযাচিত মূল্য দিয়াছেন। তাহার চোখ দিয়া দরদর ধারে জল ঝরিতে লাগিল । অশোকার কথা মনে পড়িল । আজ আর তাহার বিরুদ্ধে মনে কোনো গ্লানি নাই— শাশুড়ীর বিরুদ্ধেও না। 够 দিন কয়েক পরে তাহার আকাশ-বাসরের সঙ্গিনী আসিল স্বামীকে সঙ্গে করিয়া। স্বামীটি বোধ হয় শোধরাইয়াছে। মেয়েটি বলিল, “ধন্যবাদ জানিয়ে আপনার আকাশ-বাসর や>Q অপমান করব না। আমার স্বামী আপনার ঋণ স্বীকার করতে এসেছেন। সামর্থ্য হ’লেই শোধ দেবেন।” আর্টিষ্ট বলিল,“আমি আমার স্ত্রীর কাছে সব শুনেছি ; আপনি মহৎ লোক । আজ আমাদের আশীৰ্ব্বাদ করুন যেন আমার সমস্ত গ্লানি কাটিয়ে উঠতে পারি।” ললিত হাত তুলিয়া আশীৰ্ব্বাদ করিতে গেল, কিন্তু তাহার রুগ্ন শরীর এতটা উত্তেজনা সহ্য করিতে পারিল না। সে সহসা চোখে অন্ধকার দেখিল ও মূৰ্ছাহতের মত বসিয়া পড়িল স্বামীস্ট্রী দুজনে একসঙ্গে চমকিয়৷ উঠিয়া ললিতের ছাদে উঠিয়া আসিল । তাহাকে ধরাধরি করিয়া ডেক-চেয়ারে বসান হইল। দুজনেই সভয়ে দেখিল ললিতের গা বেশ গরম। ললিত বলিল, “ভয়নেই ; একটু অবসন্ন হ’য়ে পড়েছিলুম। এখন সেরে উঠেছি।” মেয়েটি শুনিল না, তাহার স্বামীকে ঠেলিয়া ডাক্তার আনিতে পাঠাইল । ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া শঙ্কিত হইলেন—যক্ষ্মা । স্বামীক্সী দুজনেই শিহরিয়া উঠিল। ললিতও শুনিল, কিন্তু কিছু বলিল না । তাহার ঠোটের কোণে সেই মৃদুহাসিটুকু ফুটিয়া রহিল। দুৰ্ব্বল শরীরে সে কঠিন পরিশ্রম করিয়াছে, ঠাণ্ডা লাগাইয়াছে অথচ পুষ্টিকর আহার পায় নাই, স্ত্রীর যত্ব পাইতে পারিত, কিন্তু হতভাগ্যের ভাগ্যে তাহাও জোটে নাই । শরীর আর কতদিন টিকিতে পারে ? ডাক্তার বলিলেন, “আর বেশীদিন নয় । ওঁকে নীচে নিয়ে যান আর ওর বাড়ীর লোকদের খবর দিন ।” ললিত বাকিয়া বসিল—জীবনে যাহাকে চাহিয়াও পায় নাই মৃত্যুতেও তাহাকে কাছে চাহিবে না। বলিল, “না অশোকাকে খবর দেবেন ন—এইটি মাত্র আমার একান্ত অনুরোধ। বরঞ্চ পিসীমা আস্থন ।” আর নীচের ঘরে সে মরিবে না । এই আকাশবাসরেই তাহার জীবন শেষ হইয়া যাক—এইখানেই টিন দিয়া কিম্বা টালি দিয়া উপরে একটা আচ্ছাদন তুলিয়া দিলেই হইবে ; অন্ধকার ঘরে মৃত্যুকে সে বরণ করিতে পারিবে না । টালি দিয়া ঘর তৈয়ারী হইল। পিসীমা আসিলেন ।