পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অগ্রহায়ণ অণরণ্যক Sos ছোটখাট উপত্যক । জঙ্গলের কিন্তু কোথাও বিরাম নাই—টিলার মাথায় উঠিয়া চারি দিকে চাহিয়া দেখিলাম যদি কোনো দিকে কাছারির মহাবীরের ধ্বজার আলো দেখা যায়—কোনো দিকে আলোর চিহ্নও নাই—শুধু উচুনীচু টিল ও ঝাউবন আর কাশবন—মাঝে মাঝে শাল ও আসান গাছের বনও আছে। দুই ঘণ্টা ঘুরিয়াও যখন জঙ্গলের কুলকিনারা পাইলাম না, তখন হঠাৎ মনে পড়িল নক্ষত্র দেখিয়া দিক ঠিক করি না কেন। গ্রীষ্মকাল, কালপুরুষ দেখি প্রায় মাথার উপর রহিয়াছে। বুঝিতে পারিলাম না কোনদিক হইতে আসিয়া কালপুরুষ মাথার উপর উঠিয়াছে—সপ্তর্ষিমণ্ডলও খুজিয়া পাইলাম না। স্থতরাং নক্ষত্রের সাহায্যে দিকনিরূপণের আশা পরিত্যাগ করিয়া ঘোড়াকে ইচ্ছামত ছাড়িয়া দিলাম। মাইল ছুই গিয়া জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো দেখা গেল। আলো লক্ষ্য করিয়া সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম জঙ্গলের মধ্যে কুড়ি বর্গহাত আন্দাজ পরিষ্কার স্থানে একটা খুব নীচু ঘাসের খুপরি । কুঁড়ের সামনে গ্রীষ্মের দিনেও আগুন জালানো । আগুনের নিকট হইতে একটু দূরে একটা লোক বসিয়া কি করিতেছে। আমার ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনিয়া লোকটি চমকিয়া উঠিয়া দাড়াইয়া বলিল—কে । তার পরেই আমায় চিনিতে পারিয়া তাড়াতাড়ি কাছে আসিল ও আমাকে খুব খাতির করিয়া ঘোড়া হইতে নামাইল । পরিশ্রাস্ত হইয়াছিলাম, প্রায় ছ’ঘণ্টা আছি ঘোড়ার উপর, কারণ সার্ডে-ক্যাম্পেও আমিনের পিছু পিছু ঘোড়ায় টো টো করিয়া জঙ্গলের মধ্যে ঘুরিয়াছি। লোকটার প্রদত্ত একটা ঘাসের চেটাইয়ে বসিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম— তোমার নাম কি ? লোকটা বলিল-গছু মাহাতে, জাতি গাদোতা। এ অঞ্চলে গাজোতা জাতির উপজীবিকা * চাষবাস ও পশুপালন, তাহা অামি এতদিনে জানিয়াছিলাম –কিন্তু এ লোকটা এই জনহীন গভীর বনের মধ্যে এক কি করে বুঝিতে পারিলাম না । বলিলাম—তুমি এখানে কি কর । তোমার বাড়ী cकांथांबू ? —হজুৰ, মহিষ চরাই। আমার ধর এখান থেকে দশ ক্রোশ উত্তরে ধরমপুর, লছমনিয়াটোলা। —নিজের মহিষ ? কতগুলো আছে ? লোকটা গৰ্ব্বের মুরে বলিল—পাচটা মহিষ আছে, হুজুর । পাচটা মহিষ । দস্তুরমত অবাক হইলাম। দশ ক্রোশ দূরের গ্রাম হইতে পাচটা মাত্র মহিষ সম্বল করিয়া লোকটি এই বিজন বনের মধ্যে মহিষচরির খাজনা দিয়া এক খুপরি বাধিয়া মহিষ চরায়—দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই ছোট্ট খুপরিটাতে কি করিয়া সময় কাটায়—কলিকাতা হইতে নূতন আসিয়াছি, শহরের থিয়েটার-বায়োস্কোপে লালিত যুবক আমি—বুঝিড়েই পারিলাম না। কিন্তু এদেশের অভিজ্ঞতা আরও বেশী হইলে বুঝিয়াছিলাম কেন গল্প মাহাতে ওভাবে থাকে তাহার অন্ত কোন কারণ নাই—ইহাছাড়া, যে গমু মাহাতোর জীবনের ধারণাই এইরূপ । যখন তাহার পাচটি মহিষ আছে, তখন তাহাজের চরাইতে হইবে, এবং যখন চরাইতে হইবে, তখন জঙ্গলে কুঁড়ে বাধিয়া একা থাকিতেই হইবে। এ অত্যস্ত সাধারণ কথ, ইহার মধ্যে আশ্চৰ্য্য হইবার f , , p গছু কাচা শালপাতার একটি লম্বা পিকা বা চুরুট তৈরি করিয়া অামার হাতে সসন্ত্রমে দিয়া আমার অভ্যর্থনা করিল। আগুনের আলোতে উহার মুখ দেখিলাম—বেশ চওড়া কপাল, উচু নাক, রং কালে—মুখঐ সরল, শাস্ত চোখের দৃষ্টি। বয়স যাটের উপর হইবে, মাথার চুল একটিও কালে নাই। কিন্তু শরীর এমন স্থগঠিত যে এই বয়সেও প্রত্যেকটি মাংসপেশী আলাদা করিয়া গুনিয়া লওয়া যায়। গন্থ আগুনে আরও বেশী কাঠ ফেলিয়া দিয়া নিজেও একটি শালপাতার পিকা ধরাইল। আগুনের আভায় খুপরির মধ্যে এক-আধখানা পিতলের বাসন চকু চকু করিতেছে । আগুনের কুণ্ডের মণ্ডলীর বাহিরে ঘোরতর অন্ধকার ও ঘন বন । বলিলাম—গল্প, একা এখানে থাক, জন্তু-জানোয়ারের ভয় কুরে না ? গল্প বলিল—ভয়ডর করলে কি আমাদের চলে হুজুর । আমাদের যখন এই ব্যবসা। সেদিন তো রাত্রে আমার পরির পেছনে বাধ এসেছিল। মহিষের স্থটাে বাচ্চা আছে, ওঁদের ওপর তাক । শব্দ গুনে রাত্রে উঠে টিন বাজাই, মশাল জালি, চীৎকার করি । রাত্রে আর ঘুম