পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৬৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফাগুন গভীর রাত্রির চন্দ্রালোকে আজকালের মতই হালিত, তমসাতীরের পর্ণকুটীরে কবি বাল্মীকি একমনে রামায়ণ লিখিতে লিখিতে কবে চমকিয়া উঠিয়া দেখিয়াছিলেন সূৰ্য্য অস্তাচলচুড়াবলী, তমসার কালো জলে রক্তমেঘন্তুপের ছায়া পড়িয়া আসিয়াছে, আশ্রমমৃগ আশ্রমে ফিরিয়াছে, সেদিনটিতেও পশ্চিম দিগন্তের শেষ রাঙা আলোয় মহালিখাপের শৈলচুড়া ঠিক এমনি অহরঞ্জিত হইয়াছিল, আজ আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে যেমন হইয়া আসিতেছে । সেই কত কাল আগে যেদিন চন্দ্রগুপ্ত প্রথম সিংহাসনে আরোহণ করেন, গ্রীকরাজ হেলিওডোরাস গরুড়ধ্বজ-স্তম্ভ নিৰ্ম্মাণ করেন ; রাজকন্যা সংযুক্ত যেদিন স্বয়ংবর-সভায় পৃথ্বীরাজের মূৰ্ত্তির গলায় মাল্যদান করেন ; সামুগড়ের যুদ্ধে হারিয়া হতভাগ্য দ্বারা যে-রাত্রে আগ্রা হইতে গোপনে দিল্লী পলাইলেন ; চৈতন্যদেব যেদিন ঐবাসের ঘরে সংকীৰ্ত্তন করেন ; যেদিনটিতে পলাশীর যুদ্ধ হইল—মহালিখারূপের ঐ শৈলচুড়া, এই বনানী ঠিক এমনি ছিল। তখন কাহারা বাস করিত এই সব জঙ্গলে ? জঙ্গলের অনতিদূরে একটা গ্রামে দেখিয়া আসিয়াছিলাম কয়েকখানি মাত্র খড়ের ঘর অাছে, মহুয়াবীজ ভাঙিয়া তৈল বাহির করিবার জন্য দু-খণ্ড কাঠের তৈরি একটা টেকির মত কি আছে, আর এক বুড়ীক দেখিয়াছিলাম তাহার বয়স আশী-নবই হইবে, শণের মুড়ি চুল, গায়ে খড়ি উড়িতেছে, রৌদ্রে বসিয়া বোধ করি মাথার উকুন বাছিতেছিল— ভারতচক্সের জরতীবেশধারিণী অন্নপূর্ণার মত। এখানে বসিয়া সেই বুড়ীটার কথা মনে পড়িল—এ অঞ্চলের বন্য সত্যতার প্রতীক ওই প্রাচীন বৃদ্ধ—ওরই পূৰ্ব্বপুরুষের এই বনজঙ্গলে বহু সহস্ৰ বছর ধরিয়া বাস করিয়া আসিতেছে, ধীশুখ্ৰীষ্ট যেদিন ক্রুশে বিদ্ধ হইয়াছিলেন সেদিনও উহার মহুয়াবীজ ভাঙিয়া যেরূপ তৈল বাহির করিত, আজ সকালেও সেইরূপ করিয়াছে। হাজার হাজার বছর মুছিয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে অতীতের ঘন কুঙ্কটিকায়, উহারা আজও সাতনলি ও আটাকাঠি দিয়া সেইরূপই পার্থী শিকার করিতেছে—ঈশ্বর সম্বন্ধে, জগৎ সম্বন্ধে উহাদের চিন্তাধারা বিন্দুমাত্র অগ্রসর হয় নাই। ঐ বুড়ীর দৈনন্দিন চিন্তাধারা কি জানিবার জন্ত আমি আমার এক বছরের অণরণ্যক ԿՀՏ উপার্জন দিয়া দিতে প্রস্তুত আছি। বড় কৌতুহল হয়, মনে হয় উহাদিগের মনের ধারা ঘনিষ্ঠভাবে জানিবার छछ ! বুঝি না কেন এক এক জাতির মধ্যে সভ্যতার কি বীজ লুক্কায়িত থাকে, তাহারা যত দিন বায়, তত উন্নতি করে— আবার অন্য জাতি হাজার বছর ধরিয়াও সেই এক স্থানে স্থাণুবং নিশ্চল হইয়া থাকে কেন ? বৰ্ব্বর আধ্য জাতি চার-পাচ হাজার বছরের মধ্যে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, কাব্য, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, চরক সুশ্রুত লিখিল, দেশ জয় করিল, সাম্রাজ্য পত্তন করিল, তেনাস দ্য মিলোর যুদ্ধ, পার্থেনন, তাজমহল, কোলে ক্যাথিড্রাল গড়িল, দরবারী কানেড়া ও ফিফথ সিমূফোনির স্বষ্টি করিল,—এরোপ্লেন, জাহাজ, রেলগাড়ী, বেতার, বিদ্যুৎ আবিষ্কার করিল— অথচ পাপুয়া, নিউগিনি, অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীরা আমাদের দেশের ওই মুণ্ডা, কোল, নাগ, কুকিগণ যেখানে সেখানেই কেন রহিয়াছে এই পাচ হাজার বছর ? অতীত কোনো দিনে, এই যেখানে বসিয়া আছি, এখানে ছিল মহাসমুদ্ৰ—প্রাচীন সেই মহাসমুদ্রের ঢেউ আসিয়া আছাড় খাইয়া পড়িত ক্যান্থিয়ান যুগের এই বালুময় তীরে—এখন যাহা বিরাট পৰ্ব্বতে পরিণত, হইয়াছে। এই ঘন অরণ্যানীর মধ্যে বসিয়া অতীত যুগের সেই নীল সমুদ্রের স্বপ্ন দেখিলাম। পুরা স্বত্র স্রোত পুলিনমধুনা তত্র সরিতাম্ এই বালুপ্রস্তরের শৈলচুড়ায় সেই বিশ্বত অতীতের মহাসমূদ্র বিক্ষুব্ধ উৰ্ম্মিমালার চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে—অতি স্পষ্ট সে চিহ্ন—ভূতত্ত্ববিদের চোখে ধরা পড়ে। মানুষ তখন ছিল না, এ ধরণের গাছপালাও ছিল না, যে ধরণের গাছপালা, জীবজন্তু ছিল, পাথরের বুকে তারা তাদের ছাচ রাখিয়া গিয়াছে, যে-কোনো মিউজিয়ামে গেলে দেখা যায় । • বৈকালের রোদ রাঙা হইয়া আসিয়াছে। মহালিখারূপ পাহাড়ের মাথায়। শেফালিবনের গন্ধভরা বাতালে হেমন্তের হিমের ঈষৎ আমেজ, আর এখানে বিলম্ব করা উচিত হইবে না, সন্মুখে কৃষ্ণ-একাদশীর অন্ধকার রাত্রি,