পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬০৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২১৪৬ জানাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু মুখ দিয়া তাহার কথা বাহির হইল না। সাহেব পুনশ্চ কহিলেন, আপিসের ষ্টাফের পক্ষ হইতে র্তাহাকে 'ফেয়ারওয়েল' দিবার সামান্ত একটু আয়োজন হইয়াছে, সুতরাং তিনি যেন হঠাৎ বাড়ী চলিয়া না যান । এ-পর্যন্ত সাহেবের সদাশয়তা হরিচরণ বাবুর ভালই লাগিতেছিল, কিন্তু এবার তিনি বিরক্ত বোধ করিতে লাগিলেন। মুখ ফুটিয়া সাহেবকে বলিয়াই ফেলিলেন ধে ইহার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বিদায়-অভিনন্দনের আয়োজন তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। স্বতরাং হরিবাবুর আপত্তি টিকিবার কথা নয়। কিছুক্ষণ পরেই ঘটা করিয়া তাহার কৰ্ম্মজীবনের পরিসমাপ্তি আপিসমৃদ্ধ লোকের সম্মুখে বিজ্ঞাপিত হইল। ফুলের মাল আসিল, রূপালী কাগজের উপর ছাপ বিদায়অভিনন্দন পাঠ করা হইল, যথারীতি উদ্বোধন-সঙ্গীত হইয়া গেল এবং স্বয়ং সাহেব পৰ্য্যস্ত ছোটখাট একটি বক্তৃতা দিয়া ফেলিলেন। প্রকাণ্ড হল-ঘরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ-বাট জন কেরানী ও বেয়ারার মধ্যে হরিবাৰু নিৰ্ব্বোধের মত বসিয়া রহিলেন । মনে হইল, নিজের অস্ত্যেষ্টি-উৎসবই তিনি যেন নিজের চোখে দেখিতে আসিয়াছেন । যে-ছোকর। এই সভায় পঠিত অভিনন্দনপত্ৰখানি রচনা করিয়াছে, তাহার নাম জানিতে পারিলে তিনি বোধ হয় মনে মনে তাহাকে অভিশাপ দিতেন এবং ক্ষমতায় কুঙ্গাইলে তাহার ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ বন্ধ করিয়া যাইডেন। অথচ তাহাকেই আবার এতগুলি লোকের মধ্যে দাড়াইয়া বিদায়-অভিনন্দনের একটা জবাবও দিতে হইল। ভাগ্যের পরিঃাস ধে এমনই শোচনীয় মূৰ্ত্তি লইয়া দেখা দেয় সে-কথা এত দিন পরে হরিচরণ বাবু যেন উপলব্ধি করিলেন। তিন-চার দিন কোন মতে বাড়ীতে কাটিয়া গেল। রঞ্জাস কোম্পানীর চেকখানি ব্যাঙ্কে গিয়া ক্যাশ করিতে হইল, তার পর প্লেস সিডনের বাড়ী হইতে শেয়ারের দর আনক্টিয়া, টাকাটা কোথায় নিরাপদে ইনভেষ্ট করা যায়, হরিবাৰু তাহারই একটা হিসাব করিতে লাগিলেন। কিন্তু প্রবাসী ১৩৪৪ ইহার জঙ্ক সময় কঙক্ষণই বা লাগিতে পারে । সমস্ত কাজ শেষ হইবার পরেও হাতে যেন অনেকখানি সময় থাকিয়া যায়। ট্রামের মান্থলির মেয়াদ তখনও শেষ হয় নাই, বার-চারেক খামবাজার-এসপ্লানেড ঘুরিয়া আসিলেও ঘন্ট-দেড়েকের বেশী সময় লাগে না ; উপরন্তু পরিচিত লোকজনের সহিত দেখা হইয় গেলেই হরিচরণ বাবু যেন রীতিমত বিত্রত বোধ করেন। পৃথিবীমৃদ্ধ লোক এখনও দশটা পাচটা খাটিয়া থাইতেছে, অথচ সুস্থ সবল শরীর লইয়া তিনি ইহারই ভিতর বাড়ীর গণ্ডীর মধ্যে বসিয়া নৈষ্কৰ্ম্মের সাধনা করিতেছেন, ত্রিশ বছরের কেরানীগিরির পর একথা হরিচরণ বাবুর মনে হয়, এমন কিছু বিস্ময়কর নহে। সন্ধ্যার মুখে হরিচরণ বাবু এক দিন পার্কে বেড়াইতে গিয়াছিলেন। সেখানে নিষ্কৰ্ম্মজীবনের করুণ রূপ দেখিয় র্তাহার যেন ভয় ধরিয়া গেল। কেউ হাত রূপ-বাধান লাঠি লইয়া প্রায় সামরিক ভঙ্গিমায় পা ফেলিতে ফেলিতে বিশfত্রশ বার পার্কটি প্রদক্ষিণ করিতেছেন, কেউবা শীত পড়িবার আগেই বালপোষ গায়ে জড়াইয়া এ-বৎসর শীতের প্রকোপ বড় ভীষণ হইতে পারে সে-সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করিতেছেন, কেউবা তাহার সময়ের বড়সাহেবের কড়া মেজাজের সবিস্তার পরিচয় দিয়া উৎসুক শ্রোতুমণ্ডলীর মনে ভীতিসঞ্চারের জন্য ব্যাকুল । দেখিয়া শুনিয়া হfরবাবু সেদিন আধ ঘণ্টার বেণী পার্কে থাকিতে পারেন নাই । পার্কট। তাহার কাছে পিঞ্জরাপোলের মত মনে হইয়াছিল ; পৃথিবীতে যাহাদের কাজের কোন বালাছ নাই, কৰ্ম্ম জীবনে যাহাঁদের অবসর মিলিয়াছে, তাহারাই যেন তাহাদের ক্লাস্ত নিঃশ্বাসে সন্ধার আকাশকে প্রতিনিয়ত ভারাক্রাস্ত করিয়া তুলিতেছে । মরিতে হইবে বলিয়া কত না ইহাদের দুশ্চিস্থ এবং সেই নিশ্চিত মৃত্যুকে নিকয়েকের মত ঠেকাইয়া রাখিবার জঙ্ক কি করুণ তাহাদের প্রয়াস। সেদিন হইতে হরিচরণ বাবু আর পার্কের দিকে যাইবার চেষ্টা করেন নাই । বাড়ীর আবহাওয়াও যেন জিন-দিন বিরক্তিকর হইয়া উঠিতে লাগিল । বাড়ীটি হরিচরণ বাবুর পৈতৃক সম্পত্তি । ছেলেবয়সে যেদিন তিনি প্রথম রজাস কোম্পানীতে চাকরি করিতে গিয়াছিলেন, সেদিন মনে করিয়াছিলেন,