১ম সংখ্যা ] আমাদের এই পোড়ো বাড়ী পর্য্যস্ত কখনও বাঘ আসে নাই। কিন্তু মনে পড়ে দু-একবার খুব বড় বুনো বিড়াল দেখিয়া বাঘের ছানা ভ্ৰমে আমরা বালকের ভয়ে ছুটিয়া পালাইয়াছিলাম। কেবল বুনো বিড়াল নহে, খট্রাসেরও উৎপাত অনেক ছিল। সৰ্ব্বাপেক্ষ বেশী উৎপাত ছিল সাপের । প্রথম প্রথম পাশের জঙ্গল হইতে ডাড়াশ সাপ আসিয়া প্রায়ই ঘরের দুধ খাইয়া যাইত । কখনও কখনও আমাদের মালী বর্ষার প্রথমে যখন শাকশব জির বাগান বরিত তখন ভীষণ গোষ্ণুর সাপ ফণা তুলিয়া তাহার দিকে ধাবিত হইত। আর সে “জয় ম৷ বিষহরি ! জয় ম! বিষহরি !" বলিতে বলিতে ছুটিয়া পালাইত। মনসাকে আমাদের স্থানীয় ভাষায় বিষহরি বলিত । এত সাপের ভয় সে-অঞ্চলে ছিল বলিয়াই শ্ৰীষ্টট, মৈমনসিংহ, ত্রিপুর প্রভৃতি জেলায় ঘরে ঘরে মনসা পূজা হইত। পদ্মপুরাণেই এই মনসা পূজা প্রচার হয়। আর পূর্ব-মৈমনসিংহেই এই পদ্মপুরাণের স্বষ্টি হয়। ( 8 ) বিষহরি বা মনসা পূজা সেকালে আমাদের অঞ্চলে একটা অতি প্রধান পৰ্ব্বাহ ছিল । দুর্গোৎসব সম্পন্ন হিন্দু গৃহস্থের পক্ষেই সম্ভব ছিল । সাধারণ লোকের নিজেদের বাড়ীতে এই চারিদিন ব্যাপী পূজার আয়োজন করিয়া উঠিতে পারিত না। কিন্তু বিষহরি বা মনসা পূজা প্রায় ঘরে ঘরেই হইত। শ্ৰীহট্ট সহরে তেমন বেশী দেখি নাই। বোধ হয় সহর অঞ্চলে সাপের ভয় তেমন ছিল না বলিয়াই সেখানে সাপ-কুলের দেবতার পূজার তেমন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু যে-সকল স্থান বর্ষার সময় জলে ভাসিয়া ষাইত বলিয়া মাটজঙ্গলের সাপের গ্রামের ভিতরে যাইয়া উঠিত, যেসকল অঞ্চলে এই সাপের দেবতাকে সন্তুষ্ট করা আবশুক ছিল । এইসকল নীচু জায়গায় বর্ষাকালে গোচারণের মাঠ একেবারে ডুবিয়া যাইত। এইজন্য বর্ষার জল নামিতে আরম্ভ করিলেই গ্রামের গোধন সকল গৃহস্থের বাড়ীতে আনিয়া যান্ধিয়া রাখতে হইত। বর্ষার চার মাস গৃহস্থকে প্রতিদিন নৌকা করিয়া গিয়া জল-প্লাবিত মাঠ হইতে গরুর জন্ত ঘাস কাটিয়া জানিতে হইত। এই ঘাস কাটা সত্তর বৎসর ९> সৰ্ব্বদা নিরাপদ ছিল না। প্রায়ই শুনা যাইত যে, ঘাস কাটিতে ষাইয়া মাঝে মাঝে লোক সর্পাঘাতে মরিয়াছে। এই সকল কারণেই আমাদের অঞ্চলে সেকালে বিষহরি বা মনসা পূজার এত প্রাচুর্ভাব ছিল। আর প্রায় সকলেই মনসার মূৰ্ত্তি গড়িয়া পূজা করিত। মনসার রং সাদ, প্রায়ই বাহন বিস্তৃত-ফণা কালনাগ ছিল । মনসার আভরণ ছিল সাপ, শিরে মুকুট ছিল সাপ, কাণে কুণ্ডল ছিল সাপ, হাতে বালা ছিল সাপ, বাহুতে ইণ্ডুি, গলায় হার, কটিতটে মেখলা সকলই ছিল সাপ। মনসা-পূজার মন্ত্র কি ছিল মনে নাই। তবে পূজায় ছাগাদি বলির বিধান ছিল। শ্রাবণের সংক্রাস্তিতে মনসা-পূজা হইত। ভাসানের দিন দেশময় নৌকার বাচখেলা হইত। আমাদের প্রান্তিক ভাষায় বাচ-খেলা শব্দ প্রচলিত ছিল না। আমরা ইহাকে নাও-দোঁড়ান বা নৌকা দৌড় কহিতাম। জলাকীর্ণ পল্লীগ্রামে সকল গৃহস্থেরই ঘাসের নৌকা ছিল। এসকল নৌকা লম্বা ও হালকা। অনেকটা ছিপ নৌকার মতন । সুতরাং এসকল ঘাসের নৌকাতে যখন আট দশ জন, বা কখন কখন লম্ব নৌকা হইলে, ষোল কুড়ি জন পাশাপাশি বসিয়া তালে তালে বৈঠা ফেলিয়া বাহিয়া চলিত তখন এসকল নৌকা তীরের মতন ছুটিত । নৌকা-দোঁড়ের সময় সারি গান হইত। প্রত্যেক নৌকাতেই একজন গলুইএ দাড়াইয়া সারি গানের মূল গায়ক হইত। প্রত্যেক সারি গানেই একটা মূল দোহা ছিল। সকলে সেটাই গাহিত । আর মূল-গায়ক অনেক সময় নিজে কবিতা রচনা করিয়া সেই দোহার সঙ্গে লাগাইয়া দিত । এসকল কবিতা অনেক সময় স্থানীয় সমাজের স্বকীৰ্ত্তিকুকীৰ্ত্তির কথাও প্রচার করিত। সারি গানের একটা দোহা মাত্র মনে আছে। বাড়ী ফিরিবার সময় সকলেই এই সারিট গাহিয়া ফিরিত । সে দোহাটী এই – “ঘাটে লাগাওরে নাও ওরে ভাই মাঝি । যে ঘাটে লাগাইবায় নাও দেখবায় ফুলের পানি ॥” ইহা হইতেই বুঝা যায় এই মনসা পূজা, মনসার ভাসান ও নৌকা-দোঁড়ান এসকলের ভিতর দিয়া সেকালের আমাদের গ্রাম্যজীবনের কতটা আনন্দ উল্লাস উছলিয়া
পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।