Woo প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩৩৪ [ ২৭শ ভাগ, ১ম খণ্ড তুষ্ট করিবার কোনো চেষ্টার সে ক্রট করে নাই । তিনি যখন যেভাবে চলিতে বলিয়াছেন সে তাহাই চলিয়াছে, আত্মীয় বন্ধু সকলের ঠাট্টা-বিদ্রুপ সব অগ্রাহ করিয়া। পিতামাতা সাগ্রহে বারবার আহবান করা সত্ত্বেও, সে একদিনের জন্যও বাপের বাড়ী যাইতে চাহে নাই । এত করিয়াও সে কি স্বামীর কাছে এমুনি অবহেলার জিনিষ থাকিয় গেল যে, দু'দিন চোখের আড়াল হইতেই তিনি তাহাকে একেবারে ভুলিয়া গেলেন ? না, এ ব্যবহার একেবারে অসহ । এর শোধ সে তুলিবেই, যেমন করিয়া হোকৃ। কিন্তু তাহার যদি কোনো বিপদ হইয়া থাকে ? এই চিস্তা মনে আসিবামাত্র ভাকুমতীর দুই চোখ জলে ভরিয়া গেল। হায়রে, তাহা হইলে এ পৃথিবীতে তাহার মত হতভাগিনী আর থাকিবে কে ? আমন স্বামী কি কাহারও কখনও হয় । এমন করিয়া স্ত্রীকে আর কে ভালবাসে ? জমিদার বংশের শত অনাচার-কদাচারের স্রোত তাহাকে ত একবিন্দুও স্পর্শ করে নাই, তাহার চরিত্র হীরকের মতই উজ্জল নিৰ্ম্মল থাকিয় গেছে। আজ কি শুধু ধনের মানের জন্য ভানুমতী সকল আত্মীয়-আত্মীয়ার হিংসার পাত্রী ? তাহার অসাধারণ স্বামীসৌভাগ্যই যে তাহাকে নারীকুলের সিংহাসনে বলাইয়া দিয়াছে। তাহার সস্তান হইল না বলিয়া পরের কাছে সে কত না কথা শুনিয়াছে, কিন্তু স্বামী ত তাহার এ ক্ৰট কোনোদিন ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন নাই, হাসিয়াই উড়াইয়া দিয়াছেন । ভবানী ঘরে ঢুকিয়া বলিল, "না বাছ, কোনো খবর এখনও আসেনি । তবে কৰ্ত্তা তার করেছেন জবাবের টাকা দিয়ে, আজ বেল বারোটা একটার মধ্যে ঠিক খবর আসবে। নাও, এখন হ’ল ত ? মুখ হাতগুলো ধোও এরপর । চাবিটা দাও, কাপড় জাম বার ক’রে দি ” চাবির রিট ভবানীর গায়ে ছুড়িয়া দিয়া ভাস্কমতী বলিল, “ছাই হ’ল। কি খবর যে আসবে তা মা দুর্গাই জানেন। নে, কি বার করুবি কর।” ভবানী আলমারী খুলিয়া একটি লেশ-বসানো সেমিজ একটি নীল ভায়েল ফ্লানেলের জ্যাকেট এবং একখানি লাল পাড়ের ঢাকাই শাড়ী বাহির করিল। ক্রমাগত কান্নাকাটি করিয়া এবং ভবানীর সঙ্গে ঝগড়া করিয়} ভানুমতী ক্লাস্ত হইয়া পড়িয়াছিল, সে আর কাপড় ছাড়িতে বেশী আপত্তি করিল না। ফিরিয়া আসিয়া ইঞ্জি চেয়ারে বসিতেই ভবানী চিরুণী লইয়। পিছনে দাড়াইয় তাহার চুল আঁচড়াইতে মুরু করিল। আর একজন বৃদ্ধ ঝি আসিয়া সকালের পরিত্যক্ত খাবারগুলি উঠাইয়া লইয়া গেল, এবং খানিক পরে গরম লুচি, তরকারী, সন্দেশ, এবং একবাট গরম দুধ রাখিয়া গেল। চুল বাধা শেষ হইতেই, ভবানী পিতলের টেবলুটি ভানুমতীর সাম্নে টানিয়া আনিল, এবং যতক্ষণ সে কিছু না খাইল তাহাকে কিছুতেই নিষ্কৃতি দিল না। খাওয়া শেষ করিয়া, ভবানীকে বিদায় দিয়া ভাতুমতী আবার ঘরের চারিদিকে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। এমন এক ইঞ্চি স্থান নাই, যেখানে তাহার স্বামীর কোনো না কোনো চিহ্ন বর্তমান। ঘরের ভিতর জ্ঞানদার ছবিই ঝুলিতেছে কম করিয়া বারো চৌদখান। তাহার পর তাহার বই, তাহার কাপড়, তাহার জাম, জুতা, ছড়ি, তামাকের পাইপ, ঘরময়। সবাই যেন মুক দৃষ্টিতে ভানুমতীর দিকে চাহিয়া আছে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেছে এ গৃহের অধীশ্বর কোথায় ? সে সজল চোখে জিনিষগুলি একে একে স্পর্শ করিয়া বেড়াইতে লাগিল। একটা ছবির উপর তাহার চোখ পড়িল । ইহা তাহাদের বিবাহের বৎসরে তোলা । তখনও ভানুমতী ভাল করিয়া নব্য প্রথায় চুল বাধিতে, কাপড় পরিতে শিখে নাই। ছবি তুলিবার আগে জ্ঞানদা তাহাকে নিজের হাতে সাজাইয়া দিয়াছিল, মনে করিয়া ভাকুমতীর ঠোটের কোণে একটুখানি মধুর সলাজ হাসি বিদ্যুতের মত ঝিলিক হানিয়া গেল । বাহির হইতে কে একজন গলা খাকুরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, "ঘরেই নাকি, বৌঠাকুরুণ ?” ভানুমতী পরদার ফাকে উকি মারিয়া দেখিল উদয় দাড়াইয়া আছে। অত্যন্ত ছুশ্চরিত্র বলিয়া এ বাড়ীর কেহই উদয়কে দেখিতে পারিত না । জ্ঞানদা বিশেষ করিয়া স্ত্রীকে বারণ করিয়া দিয়াছিল সে যেন উদয়কে কোনো প্রকার আত্মীয়তা করিতে প্রশ্রয় না দেয়, এমন
পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।