না পারে, এমনই লোভ লইয়া চোখ দিয়া বাহিরের চলমান দৃশ্য ও ছবিগুলিকে গোগ্রাসে গিলিতেছিলাম।
কিছুক্ষণ দেখার পর একটা জিনিস মনে বড় স্পষ্ট হইয়া ধরা পড়িল— পূর্ব বাঙ্গলার সঙ্গে বীরভূমের মাটির ও প্রকৃতির মোটেই মিল নাই। পদ্মার বৃহত্তম ও দুর্দান্ততম শাখা আড়িয়ালখাঁ নদীর পাড়ের বাঙ্গাল আমি, বীরভূমের রুক্ষ ও কঠিন লালমাটি, তাও আবার ঢেউ খেলানো ও টিলা ছড়ানো,—আমার চোখে এ ভূমি অভিনব লাগিবে বৈ কি! পাহাড় তখন পর্যন্ত চোখে দেখি নাই, ভূগোলের পুঁথিতে পড়া পাহাড় পর্যন্তই আমার দৌড়। পাথরের এই টিলাগুলিকে দেখিয়া আমি হিমালয় দেখার সুখই চাখিয়া চাখিয়া উপভোগ করিতেছিলাম। মনের জিভে যখন আস্বাদ থাকে, তখন সামান্য বস্তুতেও অসামান্য রস ও তৃপ্তি পাওয়া যায়।
একটা নদী পার হইলাম। পাড় হইতে নদীর জল যে এত নীচে থাকিতে পারে, এও আমার নূতন অভিজ্ঞতা। আমাদের পদ্মার সঙ্গে এ-নদীর কত তফাৎ। পদ্মার জল-প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রচণ্ডতা এ-দেশের নদীর নাই। পদ্মার ভয়াল গাম্ভীর্য ও তেমনি প্রবল তরঙ্গ-নর্তনেরও এখানে একান্ত অভাব।
তবু এখানকার নদীরও নিজস্ব একটা রূপ আছে। অজানা হইতে বাহির হইয়া সহায়হীন একা এই দীর্ঘপথ চলিয়া আসিয়াছে এবং তেমনি অজানা মোহানায় একাকী একদিন গিরা পৌঁছিবে—সেই পথচারী বৈরাগীর তপঃক্লিষ্ট দৃঢ়তা এর কৃশদেহের সর্বত্র ব্যাপ্ত রহিয়াছে। পূর্ববাঙলার শ্যামল স্নিগ্ধতা এ-দেশের নাই সত্য, কিন্তু এর রুক্ষ কাঠিন্যে একটি নিরাভরণ নগ্ন শক্তির প্রখরতা ও দৃঢ়তা বেশ প্রস্ফুট। ভারতবর্ষে শক্তিসাধনা ও তন্ত্র-সাধনার একটী বিশেষ পীঠভূমি নাকি এই বীরভূমি। দেশটার বাহিরের যতটা চোখে দেখিতে পাইলাম, তাতে এ কথায় অনায়াসে অন্ততঃ আমি বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারি।
১৯