পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর দেখিলেন, কত কৃষ্ণমেঘের সমুদ্র, কত বিদ্যুদগ্নিরাশি পার - হুইয়া তাহার কেশ ধরিয়া উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে। কত গগনবাসী অপসরাকিন্নরাদি মেঘতরঙ্গমধ্য হইতে মুখমণ্ডল উথিত করিয়া, শৈবলিনীকে দেখিয়া হাসিতেছে । দেখিলেন, কত গগন চারিণী জ্যোতিৰ্ম্ময়ী দেবী স্বর্ণমেঘে আরোহণ করিয়া, স্বর্ণকলেবর বিদ্যুতের মালায় ভূবিত করিয়া, কৃষ্ণকেশীৰ্বত ললাটে তারার মাল গ্রথিত করিয়া বেড়াইতেছে,— শৈবলিনীর পাপময় দেহস্থঃ পবনস্পর্শে তাহীদের জ্যোতিঃ নিবিয়| বাইতেছে ; কত গগনচরিণী ভৈরবী, রাক্ষসী, অন্ধকারবং শরীর প্রকাণ্ড অন্ধকার মেঘের উপর তেলাইয়। ভীম পাতায় ঘুৰ্বিয়। ক্রীড়া করিতেছে,—শৈবলিনীর পূতিগন্ধবিশিষ্ট মৃতদেহ দেখিয়। তাঁহাদের মুখে জল পড়িতেছে । ভাঙ্গার । করিয়! আহার করিতে অসিতেছে ; দেখিলেন, কত দেব-দেবীর বিমানের কৃষ্ণ তা শৃঙ্গ। উজ্জ্বল লোকময়ী ছায়। মেঘের উপর পড়িয়াছে ; পাছে পাপিষ্ট। শৈবলিনা শবের ছায়। বিমানের পবিত্র ছায়।ঘ লাগিলে শৈবলিনীর পjপক্ষয় হয়, এই ভয়ে তাহার। বিমান সরাঈয়া লইতেছেন । দেখিলেন, নক্ষত্রসুন্দরা গ: নীলাম্বরমধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুখ গুলি বার্টির করিয়া সকলে কিরণময় অঙ্গুলির দ্বারা পরস্পরকে শৈবলিমার শব দেখাইতেছে --বলিতেছে, দেখ ভগিনি, দেখ, মনুষ্যকটের মপে; আবার অসতী আছে ! কোন তার শিহুরির চক্ষ যুজিতেছে : কোন তার লজ্জায় মেঘে মুখ ঢাকিতেছে, কোন তার অসক্টর নাম শুনিয়! ভয়ে নিবিয়। যাইতেছে। পিশাচের শৈবলিনাকে লইয়। উদ্ধে উঠিতেছে, তার পর আরও উদ্ধ, তার ও মেঘ, আরও তার। পার হইয়। আরও উদ্ধ উঠতেছে । অতি উদ্ধে উঠিয় সেখান হইতে শৈবলিনার দেহ নরককুণ্ডে নিক্ষেপ করিবে বলিয়। উঠিতেছে । যেখানে উঠিল, সেখানে অন্ধকার, শীত-—মেধ নাই, ভার! নাই, আলো নাই, বায়ু নাই, শব্দ নাই । শল্য নাই—কিন্তু অকস্মাৎ অতিদূরে অধঃ হইতে অভিভাম কলকল ঘর বর শব্দ শুনা যাইতে লাগিল—যেন অভিদূরে, অধে+ ভাগ্রে, শত সহস্ৰ সমুদ্র এককালে গৰ্জিতেছে। পিশ+ চেরা বলিল, “ঐ নরকের কোলাহল শুনা যাইতেছে, এইখান হইতে শব ফেলিয়া দাও।” এই বলিয়া পিশাচের শৈবলিনীর মস্তকে পদাঘাত করিয়া শব ফুেলিয়া দিল। শৈবলিনী ঘুরিতে ঘুরিতে, ঘুরিতে ঘুরিতে পড়িতে লাগিল। ক্রমে ঘুর্ণগতি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, অবশেষে কুম্ভকারের চক্রের ন্যায় ঘুরিতে 8 লাগিল ; শবের মুখে, নাসিকায় রক্তবমন হইতে লাগিল । ক্রমে নরকের গর্জন নিকটে শুনা যাইতে লাগিল, পূতিগন্ধ বাড়িতে লাগিল—অকস্মাৎ সজ্ঞানমুতা শৈবলিনী দূরে নরক দেখিতে পাইল । তাহার পরেই তাহার চক্ষু অন্ধ, কর্ণ বধির হইল ; তখন সে মনে মনে চন্দ্রশেখরের ধ্যান করিতে লাগিল, মনে মনে ডাকিতে লাগিল—“কোথায় তুমি, স্বামি ! কোথায় প্রভু ! স্ত্রীজাতির জীবনসহায়, আরাধনার দেবতা, সৰ্ব্বে সৰ্ব্বমঙ্গল ! কোথায় তুমি চন্দ্রশেখর ! তোমার চরণারবিন্দে সহস্ৰ সহস্ৰ, সহস্ৰ সহস্র প্রণাম ! আমায় - । রক্ষা কর । তোমার নিকট অপরাধ করিয়া, আমি এই নরককুণ্ডে পতিত হুইতেছি--তুমি রক্ষা না করিলে কোন দেবতায় আমার রক্ষা করিতে পারে ন৷ – আমায় রক্ষা কর । তুমি আমায় রক্ষা কর, প্রসন্ন হও, এইখানে আসিয়। চরণযুগল আমার মস্তকে তুলিয়া দাও, তাহা হইলেই আমি নরক হইতে উদ্ধার পাইব ।” তখন অন্ধ, বধির, মুতী শৈবলিনীর বোধ হইতে লাগিল যে, কে তাহাকে কোলে করিয়| বসাইল— প্তাহার অঙ্গের সৌরভে দিক পূরিল। সেই দুরন্তু মধুকরব সহসা অন্তর্হিত হইল ; পূতিগন্ধের পরিবর্তে কুসুম গন্ধ ছুটিল । সহসা শৈবলিনীর বধিরত ঘুচিল— চক্ষু আবার দর্শনক্ষম হইল—সহসা শৈবলিনীর বোধ ইষ্টল-এ মৃত্যু নহে, জীবন ; এ স্বপ্ন নহে, প্রকৃত । শৈবলিনী চেতনা প্রাপ্ত হইল । চক্ষুরুন্মীলন করিয়া দেখিল, গুহামধ্যে অল্প আলোক প্রবেশ করিয়াছে ; বাহিরে পক্ষীর প্রভাতকুজন শুনা যাইতেছে। কিন্তু এ কি এ ? কাহার অঙ্কে তাহার মাথা রহিয়াছে—কাহার মুখমণ্ডল তাহার মস্তকোপরি,গগনোদিত পূৰ্ণচন্দ্রবৎ এ প্রভাতান্ধকারকে আলোকবিকীর্ণ করিতেছে ? শৈবলিনী চিনিল, চন্দ্রশেখর –ব্রহ্মচারিবেশে চন্দ্রশেখর ! চতুর্থ পরিচ্ছেদ নৌকা ডুবিল | চন্দ্রশেখর বলিলেন, “শৈবলিনি " শৈবলিনী উঠিয়া বসিল, চন্দ্রশেখরের মুখপানে চাহিল, মাথা ঘুরিল, শৈবলিনী পড়িয়া গেল ; মুখ চন্দ্র-; শেখরের চরণে ঘষিত হইল । চন্দ্রশেখর তাহাকে: ধরিয়া তুলিলেন। তুলিয় আপন শরীরের উপর ভর : করিয়৷ শৈবলিনীকে বসাইলেন।