পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

t8 !" তৃতীয় পরিচ্ছেদ - মৃত্য-গীত মুঙ্গেরে প্রশস্ত অট্টালিকামধ্যে স্বরূপচন্দ, জগৎশেঠ এবং মহাভাব চন্দ, জগৎশেঠ দুই ভাই বাস করিতেছিলেন । তথায় নিশীথে সহস্র প্রদীপ জ্বলিতেছিল । তথায় শ্বেতমশ্মরবিন্যাস-শীতল মণ্ডপমধ্যে নৰ্ত্তকীর রত্নাভরণ হইতে সেই অসংখ্য দীপমালারশ্মি প্রতিফলিত হইতেছিল । জলে জল বাধে, আর উজ্জলেই উজ্জ্বল বাধে । দীপরশ্মি উজ্জল প্রস্তরস্তম্ভে—উজ্জল স্বর্ণমুক্তা-খচিত মসনদে, উজ্জ্বল হীরকাদিখচিত গন্ধপাত্রে, শেঠদিগের কণ্ঠবিলম্বিত স্থলোজল মুক্তাহারে—আর নর্তকীর প্রকোষ্ঠ, কণ্ঠ, কেশ এবং কর্ণের আভরণে জলিতেছিল । তাহার সঙ্গে মধুর গীতশব্দ উঠিয়া উজ্জ্বলে মধুরে মিশাইতেছিল, উজ্জ্বলে মধুরে মিশিতেছিল ! যখন নৈশ-নীলাকাশে চন্দ্রোদয় হয়, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে ; যখন সুন্দরীর সজল নীলেন্দীবরলোচনে বিদ্যুচ্চকিত কটাক্ষ বিক্ষিপ্ত হয়, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে ; যখন স্বচ্ছ নীলসরোবরশায়িনী উন্মেষোন্মুখী নলিনীর দলরাজি বালস্থৰ্য্যের হেমোজ্জল কিরণে বিভিন্ন হইতে থাকে, নীলঙ্গলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৰ্ম্মিমালার উপরে দীর্ঘরশ্মি সকল নিপতিত হইয়। পদ্মপত্রস্থ জলবিন্দুকে জালিয়া দিয়া, জলচর বিহঙ্গকুলের কলকণ্ঠ বাজাইয়। দিয়া, জলপদ্মের ওষ্ঠাধর খুলিয়া দেখিতে যায়, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে ; আর যখন তোমার গৃহিণীর পাদপদ্মে ডায়মনকাট। মলভানু লুটাইতে থাকে, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে ; যখন সন্ধ্যাকালে গগনমণ্ডলে স্বৰ্য্যতেজ ডুবিয়া যাইতেছে দেখিয়া, নীলিমা তাহাকে ধরিতে ধরিতে পশ্চাৎ পশ্চাৎ দোঁড়ায়, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে —আর যখন তোমার গৃহিণী কর্ণাভরণ দোলাইয়া তিরস্কার করিতে করিতে তোমার পশ্চাৎ ধাবিত হন, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে ; যখন চন্দ্রকিরণ-প্রদীপ্ত গঙ্গাজলে বায়ুপ্রপীড়নে সফেন তরঙ্গ উৎক্ষিপ্ত হইয়! চাদের আলোতে জলিতে থাকে, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে,—আর যখন স্পাক্লিং স্তম্পেন তরঙ্গ তুলিয়া স্ফটিকপাত্রে জলিতে থাকে, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে । যখন জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রিতে দক্ষিণবায়ু মিলে, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে—যখন সলোশময় ফলাহারের পাতে রজতমুদ্রা দক্ষিণা মিলে, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে ; যখন প্রাতঃস্থৰ্য্যকিরণে হুর্ষোৎফুল্প হইয়া বসস্তের কোকিল ডাকিতে থাকে, তখন উজ্জলে মধুরে মিশে—আর যখন প্রদীপমালার আলোকে রত্নাভরণে ভূষিত হইয়া রমণী সঙ্গীত করে, তখন উজ্জ্বলে মধুরে মিশে । 够 উজ্জলে মধুরে মিশিল—কিন্তু শেঠদিগের অন্তঃকরণে তাহার কিছুই মিশিল না। র্তাহাদের অন্তঃকরণে মিশিল, গুবৃগন্‌ খা । - বাঙ্গালী রাজ্যে সমরাগ্নি এক্ষণে জলিয়া উঠিয়াছে । কলিকাতার অনুমতি পাইবার পূৰ্ব্বেই পাটনার এলিস সাহেব পাটনার দুর্গ আক্রমণ করিয়াছিলেন । প্রথমে তিনি দুর্গ অধিকার করেন ; কিন্তু মুঙ্গের হইতে মুসলমান সৈন্য প্রেরিত হইয়া, পাটনাস্থিত মুসলমানসৈন্যের সহিত একত্র হইয়া, পাটনা পুনৰ্ব্বার মীর কাসেমের অধিকারে লইয়া আইসে ; এলিস প্রভৃতি পাটনাস্থিত ইংরেজের মুসলমানদিগের হস্তে পতিত হইয়া, মুঙ্গেরে বন্দিভাবে আনীত হয়েন । এক্ষণে উভয় পক্ষে প্রকৃতভাবে রণসজ্জা করিতেছিলেন । শেঠদিগের সহিত গুরুগন খ৷ সেই বিষয়ে কথোপকথন করিতেছিলেন । নৃত্যগীত উপলক্ষমাত্র । জগৎশেঠের ব। গুরুগন খাঁ। কেহই তাহ শুনিভেছিলেন না। সকলে যাহা করে, তাহারাও তাহাই করিতেছিলেন । শুনিবার জন্য কে কবে সঙ্গীতের অবতারণা করায় ? গুরুগন থার মনস্কামন। সিদ্ধ হইল—তিনি মনে করিলেন যে, উভয় পক্ষ বিবাদ করিয়৷ ক্ষীণবল হইলে তিনি উভয় পক্ষকে পরাজিত করিয়া স্বয়ং বাঙ্গালার অধীশ্বর হইবেন । কিন্তু সে অভিলাযসিদ্ধির পক্ষে প্রথম আবশ্বক যে, সেনাগণ র্তাহারই বাধ্য থাকে । সেনাগণ অর্থ ভিন্ন বশীভূত হইবে না-শেঠকুবেরগণ সহায় না হইলে অর্থ সংগ্ৰহ হয় না । অতএব শেঠদিগের সঙ্গে পরামর্শ গুরুগন্‌ খার পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয় । এ দিকে, কাসেম আলি খাও বিলক্ষণ জানিতেন যে, যে পক্ষকে এই কুবেরযুগল অনুগ্রহ করিবেন, সেই পক্ষ জয়ী হইবে । জগৎশেঠেরা ষে মনে মনে র্তাহার অহিতাকাঙ্ক্ষী, তাহাও তিনি বুঝিয়াছিলেন । কেন না, তিনি র্তাহাদিগের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন নাই । সন্দেহবশতঃ তাহাদিগকে মুঙ্গেরে বন্দিস্বরূপ রাখিয়াছিলেন । র্তাহারা সুযোগ পাইলেই তাহার বিপক্ষের সঙ্গে মিলিত হইবেন, ইহা স্থির করিয়া তিনি শেঠদিগকে দুর্গমধ্যে আবদ্ধ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন 1. শেঠেরা তাহ! জানিতে পারিয়াছিল । এ পৰ্য্যন্ত তাহারা ভয়প্রযুক্ত মীর কাসেমের প্রতিকুলে কোন আচরণ করে নাই ; কিন্তু এক্ষণে অন্যথা