পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᎼᎭ নবকুমার কহিলেন, “না।” স্ত্রীলোক পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “চট কত দুর ?” নবকুমার কহিলেন, “কত দুর বলিতে পারি না— কিন্তু বোধ হয় নিকট " স্ত্রীলোক কহিল, “অন্ধকারে একাকিনী মাঠে বসিয়া কি করিব, আপনার সঙ্গে চটি পর্য্যস্ত যাওয়াই উচিত । বোধ হয়, কোন কিছুর উপর ভর করিতে পারিলে চলিতে পারিব।” নবকুমার কহিলেন, “বিপৎকালে কোচ মূঢ়ের কােজ । আমার কাধে ভর করিয়া চল ।” স্ত্রীলোকটি মূঢ়ের কার্য্য করিল না। নবকুমারের স্কন্ধেই ভর করিয়া চলিল । যথার্থই চটি নিকটে ছিল। এ সকল কালে চটির নিকটেও দুক্ৰিয় করিতে দম্যর সঙ্কোচ করিত না । অনধিক বিলম্বে নবকুমার সমভিব্যাহারিণীকে লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন । নবকুমার দেখিলেন যে, ঐ চটিতেই কপালকুণ্ডল অবস্থিতি করিতেছিলেন । র্তাহার দাসদাসী তজ্জন্ত একখানা ঘর নিযুক্ত করিয়াছিল । নবকুমার স্বীয় সঙ্গিনীর জন্য তৎপাশ্ববৰ্ত্তী একখানা ঘর নিযুক্ত করিয়া র্তাহাকে তন্মধ্যে প্রবেশ করাইলেন । তাহার আজ্ঞামত গৃহস্বামীর বনিত প্রদীপ জালিয়া আনিল । যখন দীপরশ্মিস্রোতঃ তাহার সঙ্গিনীর শরীরে পড়িল, তখন নবকুমার দেখিলেন যে, ইনি অসামান্ত স্বন্দরী । রূপরাশিতরঙ্গে তাহার যৌবন-শোভা শ্রাবণের নদীর দ্যায় উছলিয়া পড়িতেছিল । দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পান্থনিবাসে “ঙ্কৈস ঘোষিৎ প্রকৃতিচপলা " —উদ্ধবদূত । যদি এই রমণী নির্দোষসৌন্দর্য্যবিশিষ্ট হইতেন, তবে বলিতাম, পুরুষ পাঠক ! ইনি আপনার গৃহিণীর দ্যায় সুন্দরী । আর সুন্দরী পাঠকারিণি ! ইনি আপনার দর্পণস্থ ছায়ার ন্যায় রূপবতী । তাহ হইলে রূপবুর্ণনার একশেষ হইত । দুর্ভাগ্যবশতঃ ইনি সৰ্ব্বাঙ্গ মুন্দরী নহেন ; সুতরাং নিরস্ত হইতে হইল । ইনি যে নির্দোষমুন্দরী নহেন, তাহা বলিবার কারণ এই যে, প্রথমতঃ ইহার শরীর মধ্যমাকৃতির বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী । অপেক্ষ কিঞ্চিৎ দীর্ঘ ; দ্বিতীয়তঃ অধরেীষ্ঠ কিছু চাপা ; তৃতীয়তঃ প্রকৃতপক্ষে ইনি গৌরাঙ্গী নহেন। শরীর ঈষদীর্ঘ বটে, কিন্তু হস্তপদ-হৃদয়াদি সৰ্ব্বাঙ্গ স্বগোল, সম্পূর্ণভূত। বর্ষাকালে বিটপিলত যেমন আপন পত্ররাশির বাহুল্যে দলমল করে, ইহার শরীর তেমনই আপন পূর্ণতায় দলমল করিতেছিল ; সুতরাং ঈষদীর্ঘ দেহও পূর্ণতাহেতু অধিকতর শোভার কারণ হইয়াছিল । র্যাহাদিগকে প্রকৃতপক্ষে গৌরাঙ্গী বলি, র্তাহাদিগের মধ্যে কাহারও বর্ণ পূর্ণচন্দ্রকৌমুদীর স্থায়, কাহারও কাহারও ঈষদারত্তবদনা উষার স্থায় । ইহার বর্ণ এতদুভয়বর্জিত ; সুতরাং ইহাকে প্রকৃত গৌরাঙ্গী বলিলাম না বটে, কিন্তু মুগ্ধকরী শক্তিতে ইহার বর্ণও নূ্যন নহে। ইনি শু্যামবর্ণ । “ষ্ঠামা মা” বা “শু্যামসুন্দর” যে শু্যামবর্ণের উদাহরণ, এ সে শুiমবর্ণ নহে, তপ্তকাঞ্চনের যে শু্যামবর্ণ, এ সেই খাম। পূৰ্ণচন্দ্রকরলেখা, অথবা হেমাম্বুদকিরাটিনী উষা যদি গৌরাঙ্গীদিগের বর্ণপ্রতিমা হয়, তবে বসন্ত প্রস্থত নবচুতদলরাজির শোভা এই খামার বর্ণের অনুরূপ বলা যাইতে পারে । পাঠকমহাশয়দিগের মধ্যে অনেকে গৌরাঙ্গীর বর্ণের প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন, কিন্তু যদি কেহ এরূপ শুমার মন্ত্রে মুগ্ধ হয়েন, তবে তাহাকে বর্ণজ্ঞানশূন্ত বলিতে পারিব না। এ কথায় যাহার বিরক্তি জন্মে, তিনি একবার নবচুত পল্লববিরাজী ভ্রমরশ্রেণীর ন্যায় সেই উজ্জলশ্যামললাটবিলম্বী অলকাবলী মনে করুন । সেই সপ্তমীচন্দ্রাকৃতললাট তলস্ত অলকম্পর্শী ভ্ৰযুগ মনে করুন ; সেই পঙ্কচুতোজ্জল কপোলদেশ মনে করুন ; তন্মধ্যবর্তী ঘোরারক্ত ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর মনে করুন ; তাহ হইলে এই অপরিচিত রমণীকে সুন্দরীপ্রধান বলিয়া অনুভূত হইবে । চক্ষু দুইটি অতি বিশাল নহে, কিন্তু সুবঙ্কিম পল্লবরেখাবিশিষ্ট —আর অতিশয় উজ্জল । তাহার কটাক্ষ স্থির, অথচ মৰ্ম্মভেদী । তোমার উপর দৃষ্টি পড়িলে তুমি তৎক্ষণাৎ অনুভূত কর যে, এ স্ত্রীলোক তোমার মন পর্য্যস্ত দেখিতেছে । দেখিতে দেখিতে সে মৰ্ম্মভেদী দৃষ্টির ভাবাস্তর হয় ; চক্ষু সুকোমল স্নেহময় রসে গলিয়া যায়। আবার কখন ব| তাহাতে কেবল মুখাবেশজনিত ক্লাস্তিপ্রকাশমাত্র, যেন সে নয়ন মন্মথের স্বপ্রশয্যা । কখন বা লালসাবিস্ফারিত মদনরসে টলমলায়মান । আবার কখন লোলাপাঙ্গে ক্রর কটাক্ষ–যেন মেঘমধ্যে বিদ্যুন্ধাম । মুখকান্তিমধ্যে দুইটি অনিৰ্ব্বচনীয় শোভা ; প্রথম সৰ্ব্বত্ৰগামিনী বুদ্ধির প্রভাব, দ্বিতীয় মহান আত্মগরিমা । তৎকারণে যখন তিনি মরালগ্ৰীব বঙ্কিম