পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/২৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দেবী চৌধুরাণী আর সকলকে বিদায় দিয়াছি। ভোমরা তখন গেলে না । কিন্তু আমায়'এই ভিক্ষ দাও—আমার স্বামীর নৌকায় উঠিয়া পলায়ন করিও । - নিশি । ধড়ে প্রাণ থাকিতে তোমায় ছাড়িব না । মরিতে হয়, একত্র মরিব । দেবী। ও সকল কথা এখন থাক, যাহা বলিতেছিলাম, তাহ বলিয়া শেষ করি । যাহা চক্ষুষ-প্রত্যক্ষ করিতে পারিতেছিলে না, তাহ যেমন দূরবীণের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করিলে, তেমনি ঈশ্বরকে মানস-প্রত্যক্ষ করিতে দূরবীণ চাই । দিবা । মনের আবার দূরবীণ কি ? দেবী ! যোগ । দিব । কি—সেই ন্যাস, প্রাণায়াম, কুম্ভক, বুজরুকি, ভেন্ধী— দেবী। তাকে আমি যোগ বলি না । যোগ অভ্যাসমাত্র। কিন্তু সকল অভ্যাসই যোগ নয়। তুমি যদি দুধ-বি থাইতে অভ্যাস কর, তাকে যোগ বলিব না । তিনটি অভ্যাসকেই যোগ বলি । দিব| কি কি তিনটি ? দেবী । জ্ঞান, কৰ্ম্ম, ভক্তি । যোগ, ভক্তিযোগ । ততক্ষণ নিশি দূরবীণ লইয়া এদিক ওদিক্‌ দেখিতেছিল । দেখিতে দেখিতে বলিল, “সম্প্রতি উপস্থিত গোলযোগ । ” দেবী । কি ? নিশি । একখানা পান্‌সী আসিতেছে । বুঝি ইংরেজের চর । দেবী মিশির হাত হইতে দূরবীণ লইয়। পামূলী দেখিল । বলিল, “এই আমার সুযোগ । তিনিই আসিতেছেন । তোমরা নীচে যাও ।” দিবা ও নিশি ছাদ হইতে নামিয়া কামরার ভিতর গেল। পানূপী ক্রমে বাহিয়া আসিয়া বজরার গায়ে লাগিল। সেই পামূলীতে—ব্রজেশ্বর। ব্ৰজেশ্বর লাফাইয়া বজরায় উঠিয়া পানূসী তফাতে বাধিয়া রাখিতে হুকুম দিলেন । পানূসাওয়ালা তাহাই করিল। ব্ৰজেশ্বর নিকটে আসিলে দেবী উঠিয়া দাড়াইয়৷ আনতমস্তকে তাহার পদধূলি গ্রহণ করিল। পরে উভয়ে বসিলে ব্ৰজেশ্বর বলিল, “আজ টাকা আনিতে পারি নাই, দুই চারি দিনে দিতে পারিব, বোধ হয় । দুই চারি দিনের পরে কবে কোথায় তোমার সঙ্গে দেখা হুইবে, সেটা জানা চাই ।” জ্ঞানযোগ, কৰ্ম্ম সে আবার কি ? আবার গোলযোগ (t○ ও ছি! ছি ! ব্রজেশ্বর ! দশ বছরের পর প্রফুল্লের সঙ্গে এই কি কথা ! দেবী উত্তর করিল, “আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হইবে না”—বলিতে বলিতে দেবীর গলাটা বুজিয়া আসিল,—দী একবার চোখ মুছিল—“আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না, কিন্তু আমার ঋণ শুধিবার অন্য উপায় আছে । যখন সুবিধ৷ হইবে, ঐ টাকা গরীবঃখীকে বিলাইয় দিবেন—ত্তাহ হইলে আমি পাইব ।” ব্রজেশ্বর দেবীর হাত ধরিল। তোমার টাক{—” ছাই টাকা ! কথা শেষ হইল ন-মুখের কথা মুখে রহিল । যেমন ব্রজেশ্বর "প্রফুল্ল” বলিয়া ডাকিয়া হাত ধরিয়াছে, আমনি প্রফুল্লের দশ বছরের বাধা বাধ ভাঙ্গিয়া, চোখের জলের স্রোত ছুটিল । ব্রজেশ্বরের ছাই টাকার কথা সে স্রোতে কোথায় ভাসিয়া গেল । তেজস্বিনী দেবী রাণী ছেলেমানুষের মত বড় কান্নাটা কঁাদিল । ব্ৰজেশ্বর তখন বড় বিপন্ন হইল। র্তার মনে মনে বোধ আছে যে, এ পাপীয়সী ডাকাইতি করিয়া খায়, এর জন্ত এক ফেঁাটাও চোখের জল ফেলা হবে না । কিন্তু চোখের জল অ ত বিধি-ব্যবস্থা অবগত নর, তারা অনাহূত আসিয়া ব্রজেশ্বরের চোখ ভরিয়া দিল । ব্রজেশ্বর মনে করিল, হাত উঠাইয়৷ চোখ মুছিলেই ধরা পড়িল । কাজেই চোখ মোছা হইল না । চোখ যখন মোছা হইল না, তখন পুকুর বলিল, “প্রফুল্ল ! ছাপাইল—গাল বাহিয়া ধারা চলিল—প্রফুল্লের হাতে পড়িল । তখন বালির বাধটা ভাঙ্গিয়া গেল । ব্ৰজেশ্বর মনে করিয়া আসিয়াছিল যে, প্রফুল্লকে ডাকাইতি করার জন্য ভারি রকম তিরস্কার করিব, পাপীয়সী বলিব, আরও দুই চারিট লম্বা-চোঁড়া কথা বলিয়া আবার একবার জন্মের মত ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইব । কিন্তু কেঁদে যার হাত ভিজিয়ে দিল, তার উপর কি আর লম্বা-চৌড়া কথা হয় ? তখন চক্ষু মুছিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “দেখ প্রফুল্ল ! তোমার টাকা আমার টাকা—তার পরিশোধের জন্য আমি কেন কাতর হব ? কিন্তু আমি বড় কাভরই হইয়াছি । আমি আজ দশ বৎসর কেবল তোমাকেই ভাবিয়াছি । আমার আর দুই স্ত্রী আছে—আমি তাহাদিগকে এ দশ বৎসর স্ত্রী মনে করি নাই, তোমাকেই স্ত্রী জানি । কেন, তা বুঝি তোমায় আমি বুঝাইতে পারিব না। শুনিয়াছিলাম, তুমি নাই। কিন্তু আমার পক্ষে তুমি ছিলে। আমি