পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

§ রোহিণীকে গ্রহণ করিয়াই জানিয়াছিলেন যে, এ :রোহিণী, ভ্রমর নহেন—এ রূপতৃষ্ণ, এ স্নেহ নহে—এ ভোগ, এ মুখ নহে—এ মন্দারঘর্ষণ-পীড়িত বাসুকিনিশ্বাসনির্গত হলাহল, এ ধন্বন্তরিভাণ্ডনিঃস্থত মুধা সুন্নহে। বুঝিতে পারিলেন যে, এ হৃদয়সাগর মন্থনের উপর মন্থন করিয়া যে হলাহল তুলিয়াছি, তাহ অপরি হাৰ্য্য, অবশু পান করিতে হইবে—-নীলকণ্ঠের ন্যায় গোবিন্দলাল সে বিষ পান করিলেন । নীলকণ্ঠের কণ্ঠস্থ বিষের মত সে বিষ তাহার কণ্ঠে লাগিয়া রহিল । সে বিষ জীর্ণ হইবার নহে-সে বিষ উদগীর্ণ করিবার মহে, কিন্তু তখন সেই পূৰ্ব্বপরিজ্ঞাতস্বাদ বিশুদ্ধ ভ্রমরপ্রণয়স্থধা—স্বৰ্গীয় গন্ধযুক্ত, চিত্তপুষ্টিকর, সৰ্ব্বরোগের ঔষধস্বরূপ, দিবারাত্রি স্মৃতিপথে জাগিতে লাগিল । যখন প্রসাদপুরে গোবিন্দলাল রোহিণীর সঙ্গীতস্রোতে ভাসমান, তখনই ভ্রমর তাহার চিত্তে প্রবলপ্রতাপযুক্ত অধীশ্বরী—ত্ৰমর অন্তরে, রোহিণী বাহিরে । তখন ভ্রমর অপ্রাপণীয়া, রোহিণী অত্যাজ্য,~—তবু ভ্রমর অন্তরে, রোহিণী বাহিরে । তাই রোহিণী অত শীঘ্র মরিল । যদি কেহ সে কথা না বুঝিয়া থাকেন, তবে বৃথাই এ আখ্যায়িকা লিখিলাম। যদি তখন গোবিন্দলাল, রোহিণীর যথাবিচিত ব্যবস্থা করিয়া স্নেহময়ী ভ্রমরের কাছে যুক্তকরে জাসিয়া দাড়াইত, বলিত, “আমায় ক্ষমা কর, আমায় আবার হৃদয়প্রান্তে স্থান দাও।” যদি বলিত, “আমার এমন গুণ নাই, যাহাতে আমায় তুমি ক্ষমা করিতে , পার, কিন্তু তোমার ত অনেক গুণ আছে, তুমি নিজগুণে আমায় ক্ষমা কর,” বুঝি তাহা হইলে, ভ্রমর তাহাকে ক্ষমা করিত। কেন না, রমণী ক্ষমাময়ী, দয়াময়ী, স্নেহময়ী,~~রমণী ঈশ্বরের কীৰ্ত্তির চরমোৎকর্ষ, দেবতার ছায়া ; পুরুষ দেবতার সৃষ্টিমাত্র । স্ত্রী আলোক, পুরুষ ছায় । আলো কি ছায়া ত্যাগ করিতে পারিত ? গোবিনদলাল তাহ পারিল না । কতকটা অহঙ্কার—পুরুষ অহঙ্কারে পরিপূর্ণ। কতকটা লজ্জা— ফুস্কৃতকারীর লজ্জাই দণ্ড । কতকটা ভয়—পাপ সহজে পুণ্যের সন্মুখীন হইতে পারে না। ভ্রমরের কাছে আর মুখ দেখাইবার পথ নাই । গোবিন্দলাল আর অগ্রসর হইতে পারিল না । তাহার পর গোবিন্দলাল হত্যাকারী। তখন গোবিন্দলালের আশা-ভরসা ফুরাইল। অন্ধকার আলোকের সন্মুখীন হইল না। কিন্তু তবু সেই পুনঃপ্রজলিত দুৰ্ব্বার দাহকারী ভ্রমরদর্শনের লালসা বর্ষে বর্ষে, মাসে মাসে, দিনে দিনে, দণ্ডে দণ্ডে, পলে পলে, গোবিন্দলালকে দাহ করিতে বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী লাগিল । কে এমন পাইয়াছিল ? কে এমন হারাইয়াছে ? ভ্রমরও দুঃখ পাইয়াছিল, গোবিন্দলালও ঃখ পাইয়াছিল। কিন্তু গোবিন্দলালের তুলনায় ভ্রমর সুখী । গোবিন্দলালের দুঃখ মনুষ্যদেহে অসহ্য । ভ্রমরের সহায় ছিল—ষম । গোবিন্দলালের সে সহায়ও নাই । আবার রজনী পোহাইল—আবার স্বর্য্যালোকে জগৎ হাসিল । গোবিন্দলাল গুহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন । রোহিণীকে গোবিন্দলাল স্বহস্তে বধ করিয়াছেন।---ভ্রমরকেও প্রায় স্বহস্তে বধ করিয়াছেন —তাই ভাবিতে ভাবিতে বাহির হইলেন । আমরা জানি না যে, সে রাত্রি গোবিন্দলাল কি প্রকারে কাটাইয়াছিলেন । বোধ হয়, রাত্রি বড় ভয়ানক গিয়াছিল। দ্বার খুলিয়াই মাধবীনাথের সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ হইল। মাধবীনাথ তাহাকে দেখিয়া মুখপানে চাহিয়া রহিলেন–মুখে ময়ূন্যের সাধাতীত রোগের ছায়া । মাধবীনাথ তাহার সঙ্গে কথা কহিলেন না । মাধবীনাথ মনে মনে প্রতিজ্ঞ করিয়াছিলেন যে, ইহজন্মে আর গোবিন্দ্রলালের সঙ্গে কথা কহিবেন না । ৰিনাবাক্যে মাধবীনাথ চলিয়া গেলেন । গোবিন্দ্রলাল গৃহ কৃষ্টতে নিক্রোস্ত হইয়া ভ্রমরের শয্যাগুহতলস্ত সেই পুষ্পোদ্যানে গেলেন । যামিনী যথার্থই বলিয়াছেন, সেখানে আর পুষ্পোপ্তান নাই । সকলই ঘাস, খড় ও জঙ্গলে পূরিয়া গিয়াছে। দুই একটি অমর পুষ্পবৃক্ষ সেই জঙ্গলের মধ্যে অৰ্দ্ধমৃতবৎ আছে—কিন্তু তাহাতে আর ফুল ফুটে না। গোবিন্দ’ লাল অনেকক্ষণ সেই খড়বনের মধ্যে বেড়াইলেন । অনেক বেলা হইল, রৌদ্রের অত্যন্ত তেজঃ হইল— গোবিন্দলাল বেড়াইয় বেড়াইয়! শ্রাস্ত হইয়া শেষে নিষ্ক্রান্ত হইলেন । তথা হইতে গোবিন্দলাল কাহারও সঙ্গে বাক্যালাপ না করিয়া, কাহারও মুখপানে ন চাহিয়, বারুণীপুষ্করিণীর তটে গেলেন । বেলা দেড় প্রহর হইয়াছে ? তীব্র রেীদের তেজে বারণীর গভীর কৃষ্ণোৰ্জ্জল বারি রাশি জ্বলিতেছিল । স্ত্রী-পুরুষ বহুসংখ্যক লোক ঘাটে স্নান করিতেছিল—ছেলের কালো জলে স্ফটিক চুর্ণ করিতে করিতে সীতার দিতেছিল। গোবিন্দলালের তত লোক-সমাগম ভাল লাগিল না । ঘাট হইতে যেখানে বারুণীতীরে তাহার সেই নানাপুষ্পরঞ্জিত নননিতুল্য পুষ্পোদ্যান ছিল, গোবিনলাল সেই দিকে গেলেন । প্রথমেই দেখিলেন, রেলিং ভাঙ্গিয়া গিয়াছে--সেই লৌহ-নিৰ্ম্মিত বিচিত্র দ্বারের