পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/১৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সীতারাম হাড়ে হাড়ে লাগিল। রমার অপরাধ যাই হৌক, স্বামি-পুত্রের প্রতি অতিশয় স্নেহই তাহার মূল । পাছে তাহাদের কোন বিপদ ঘটে, এই চিন্তাতেই সে এত ব্যাকুল সীতারাম তাহ ন বুঝিতেন, এমন নহে । বুঝিয়াও রমার প্রতি প্রসন্ন থাকিতে পরিলেন না —বড় ঘ্যান্‌শ্ব্যান্‌, প্যাম্প্যান, বড় কাজের বিঘ্নবড় যন্ত্রণা। স্ত্রীপুরুষের পরম্পর ভালবাসাই দাম্পত্যসুখ নহে, একাভিসন্ধি—সহৃদয়ত—ইহাই দাম্পতাসুখ । রমা বুঝিল, বিনাপরাধে আমি স্বামীর স্নেহ হারাইয়াছি । সীতারাম ভাবিল, “গুরুদেব ! রমার ভালবাস হইতে আমায় উদ্ধার কর ।” রমার দোষে, সীতারামের হৃদয়স্থিত সেই চিত্রপট দিন দিন আরও উজ্জল প্রভাবিশিষ্ট হইতে লাগিল । সীতারাম মনে করিয়াছিলেন, রাজ্য সংস্থাপন ভিন্ন আর কিছুকেই তিনি মনে স্থান দিবেন না-কিন্তু এখন শ্ৰী আসিয়া ক্রমে ক্রমে সেই সিংহাসনের আধ খান জুড়িয়। বসিল । সাঁতারাম মনে করিলেন, আমি শ্রীর কাছে যে পাপ করিয়াছি, রমার কাছে তাহার দণ্ড পাইতেছি । ইহার জন্য প্রায়শ্চিত্ত চাই । কিন্তু এ মন্দিরে এ প্রতিমা স্থাপনে যে রমাই এক ব্ৰতী, এমন নহে, নন্দাও তাহার সহায় ; কিন্তু আর এক রকমে । মুসলমান হইতে নন্দার কোন ভয় নাই । যখন সীতারামের সাহস আছে, তখন ননদীর সে কথার আনেদালনে প্রয়োজন নাই । নন্দ| বিবেচনা করিত, সে কথার ভাল-মন্দের বিচারক আমার স্বামী—তিনি যদি ভাল বঝেন, তবে আমার সে ভাবনায় কাজ কি ? তাই নন্দ সে সকল কথাকে মনে স্থান ন দিয়। প্রাণপাত করিয়া পতিপদসেবায় নিযুক্ত । মাতার মত স্নেহ, কন্যার মত ভক্তি, দাসীর মত সেবা, সীতারাম সকলই নন্দার কাছে পাইতেছিলেন । কিন্তু সহধৰ্ম্মিণী কই ? যে তাহার উচ্চ আশায় আশাবতী, হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষার ভাগিনী, কঠিন কার্যের সহায়, সঙ্কটে মন্ত্রী, বিপদে সাহসদায়িনী, জয়ে আনন্দময়ী, সে কই ? বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মী ভাব, কিন্তু সমরে সিংহবাহিনী কই ? তাই নন্দার ভালবাসায় সীতারামের পদে পদে শ্ৰীকে মনে পড়িত, পদে পদে সেই সংক্ষুব্ধ সৈন্তসঞ্চালিনীকে মনে পড়িত। “মার ! মার ! শক্ৰ মার ! দেশের শক্র, হিন্দুর শক্র, আমার শত্রু মার!” সেই কথা মনে পড়িত। সীতারাম তাই মনে মনে সেই মহিমময়ী সিংহবাহিনী মূৰ্ত্তি পূজা করিতে লাগিলেন । প্রেম কি, তাহা আমি জানি না। দেখিল অঞ্জি মজিল, আর কিছুই মানিল না, কই, এমন দাবানল ত সংসারে দেখিতে পাই না । প্রেমের কথা পুস্তকে পড়িয়া থাকি বটে, কিন্তু সংসারে ‘ভালবাসা’ স্নেহ ভিন্ন । প্রেমের মত কোন সামগ্ৰী দেখিতে পাই নাই ; সুতরাং তাহার বর্ণনা করিতে পারিলাম না । প্রেম যাহা পুস্তকে বর্ণিত, তাহা আকাশকুসুমের মত কোন একটা সামগ্ৰী হইতে পারে যুবক-যুবতাগণের মনোরঞ্জন জন্য কবিগণ কর্তৃক স্বল্প হইয়াছে বোধ হয়। তবে একটা কথা স্বীকার করিতে হয় । ভালবাসা বা স্নেহ,—যাহা সংসারে এত অাদরের, তাহ পুরাতনেরই প্রাপ্য নুতনের প্রতি জন্মে না । যাহার সংসর্গে অনেক কাল কাটাইয়াছি, বিপদে, সম্পদে, সুদিনে, দুৰ্দ্দিনে যাহার গুণ বুঝিয়াছি, সুখ-দুঃখের বন্ধনে যাহার সঙ্গে বদ্ধ হইয়াছি, ভালবাস। ব! স্নেহ তাহারই প্রতি জন্মে। কিন্তু নূতন আর একটা সামগ্ৰী পাইয় থাকে । নুতন বলিয়াই তাহার একটা আদির আছে । কিন্তু তাহ ছাড়া আরও আছে । , তাহার গুণ জানি না, কিন্তু চিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়া লইতে পারি। যাহা পরীক্ষিত, তাহ সীমাবদ্ধ ; যাহা অপরীক্ষিত, কেবল অনুমিত, তাহার সীম। দেওয়া না দেওয়! মনের অবস্থার উপর নির্ভর করে । তাই নুতনের গুণ অনেক সময়ে অসীম বলিয়া বোধ হয় । তাই সে নূতনের জন্ত বাসন দুৰ্দ্দমনীয়৷ হইয় পড়ে। যদি ইহাকে প্রেম বল, তবে সংসারে প্রেম আছে । সে প্রেম বড় উন্মাদকর বটে। নূতনেরই তাহ প্রাপা । তাহার টানে পুরাতন অনেক সময়ে ভাসিয়। ষায় । শ্ৰী সীতারামের পক্ষে নূতন । ত্রীর প্রতি সেই উন্মাদকর প্রেম সীতারামের চিত্ত অধিকৃত করিল । তাহার স্রোতে নন্দ রম! ভাসিয়া গেল । হায় নুতন ! তুমিই কি সুন্দর ? না সেই পুরাতনই সুন্দর ? তবে, তুমি নুতন ! তুমি অনন্তের অংশ। অনন্তের একটুখানি মাত্র আমরা জানি । সেই একটুখানি আমাদের কাছে পুরাতন ; অনন্তের অীর সব আমাদের কাছে নুতন । অনস্তের যাহা অজ্ঞাত, তাহাও অনন্ত । নুতন ! তুমি অনন্তেরই অংশ ; তাই তুমি এত উন্মাদকর। ঐ আজ সীতারামের কাছে—আনস্তের অংশ । হায় ! তোমার আমার কি নূতন মিলিবে না ? তোমার আমার কি ঐ মিলিবে না ? ষে দিন সব পুরাতন ছাড়িয়া যাইব, সেই দিন সব নুতন পাইব, অনন্তের সম্মুখে মুখামুখী হইয়া দাড়াইব । নয়ন