পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সম্পূর্ণায়ত, ললিত মধুর অথচ উজ্জল জ্যোতিবিশিষ্ট দেহ, তাহার দেবোপম স্থৈৰ্য্য—দেবদুল্লভ শাস্তি— সকলে বিমুগ্ধ হইয়া দেখিতে লাগিল । দেখিল, জয়ন্তীর নবরবিকরপ্রোদ্ভিন্ন পদ্মবৎ অপূৰ্ব্ব প্রফুল্ল মুখ ; এখনও অধরভর মুহু মূহ মধুর স্নিগ্ধ বিনম্র হাস্ত— সৰ্ব্ববিপসংহারিণী শক্তির পরিচয়স্বরূপ সেই স্নিগ্ধ গধুর মন্দহান্ত ! দেখিয়া অনেকে দেবতাক্তানে যুক্ত করে প্রণাম করিল। যখন কতকগুলি লোক দেখিল, আর কতকগুলি লোক জয়ন্তীকে প্রণাম করিতেছে-- যখন তাহাদের মনে সেই ভক্তিভাব প্রবেশ করিল, তখন তাহারা “জয় মায়ীকি জয় ! জয় লছমী মায়ীকি জয় !” ইত্যাদি ঘোররবে জয়ধ্বনি করিল । সেই জয়ধ্বনি ক্রমে ক্রমে প্রাঙ্গণের এক ভাগ হইতে অপর ভাগে, এক প্রস্ত হইতে অপর প্রান্তে গিরিশ্রেণীস্তিত বজ্রনাদের মত প্রক্ষিপ্ত ও প্রধাবিত হইতে লাগিল ! শেষ এই সমবেত লোকসমারোহ এককণ্ঠ হইয়। তুমুল জয়শব্দ করিল ! পুরী কম্পিত হইল । চণ্ডালের হস্ত হইতে বেত্র খসিয়া পড়িল ৷ জয়ন্তী মনে মনে ডাকিতে লাগিল, “জয় জগদীশ্বর ! তোমারই জয় ! তুমি আপনিই এই লোকরণ, আপনিই এই লোকের কণ্ঠে থাকিয়া, আপনার জয়নাদ আপনিই দিতেছ : জয় জগন্নাথ ! তোমারই জয় ! আমি কে ?" ক্রুদ্ধ রাজা তখন অগ্নিমূৰ্ত্তি হইয়া মেঘগম্ভীরস্বরে চণ্ডালকে আজ্ঞ করিলেন, “কাপড় কড়িয়া নিয়া বেত লাগা ” এই সময়ে চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার সহসা রাজসমীপে আসিয়া রাজার দুইটি হাত ধরিলেন । বলিলেন, “মহারাজ ! ক্ষমা কর । আমি আর কখনও ভিক্ষা চাহিব না, এইবার আমায় এই ভিক্ষা দাও—ইহাকে ছাড়িয়া দাও।” রাজা । ( ব্যঙ্গের সহিত ) কেন, দেবতার এমন সাধ্য নাই ষে, আপনি ছাড়িয়া যায় ? বেট জুয়াচোরের উচিত শাসন হইতেছে । চন্দ্র । দেবতা ন হইল—স্ত্রীলোক বটে । রাজা । স্ত্রীলোককেও রাজা দণ্ড করিতে পারেন । চন্দ্র। এই জয়ধ্বনি শুনিতেছেন ? এই জয়ধ্বনিতে আপনার রাজার নাম ডুবিয়া যাইতেছে। রাজা । ঠাকুর । আপনার কাজে যাও । পুথিপাজি নাই কি ? চন্দ্রচূড় চলিয়া গেলেন । তখন চণ্ডাল পুনরপি রাজআজ্ঞা পাইয়। আবার বেত উঠাইল— বেত উচু করিল-জয়ন্ত্রীর মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিল ; বেত নামাইয়া রাজার পানে চাহিল— বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী শেষ বেত আছড়াইয়া ফেলিয়া দিয়া দাড়াইয়া রহিল । “কি ?” বলিয় রাজা বজের দ্যায় শব্দ করিলেন । চণ্ডাল বলিল, “মহারাজ ! আম হইতে হইবে না ।” রাজা বলিলেন, “তোমাকে শুলে যাইতে হইবে।” চণ্ডাল ষোড়হাত করিয়া বলিল, “মহারাজের হুকুমে তা পারিব । এ পারিব ন৷ ” তখন রাজা অনুচরবর্গকে আদেশ করিলেন, “চণ্ডালকে ধরিয়া লইয়া গিয়া কয়েদ কর " রক্ষিবর্গ চণ্ডালকে ধরিবার জন্ত মঞ্চের উপর আরোহণ করিতে উদ্যত দেখিয়া জয়ন্তী সীতারামকে বলিলেন, “এ ব্যক্তিকে পীড়ন করিবেন না, আপনার যে আজ্ঞা, আমি নিজেই পালন করিতেছি---চণ্ডাল বা জল্লাদের প্রয়োজন নাই ।” তথাপি রক্ষিবর্গ চণ্ডালকে ধরিতে আসিতেছে দেখিয়া, জয়ন্তী তাহাকে বলিল, “বাছা! তুমি আমার জন্য কেন দুঃখ পাইবে ? আমি সন্ন্যাসিনী, আমার কিছুতেই সুখদুঃখ নাই ; বেতে আমার কি হইবে ? অার বিবস্ত্র —সন্নাসীর পক্ষে সবস্ত্র বিবস্ত্র সমান । কেন দুঃখ প{ও--বেত তোল । চণ্ডাল বেত উঠাইল না ; জয়ন্তী তখন চণ্ডালকে বলিল, “বাছা ! স্ত্রীলোকের কথা বলিয়া বিশ্বাস করিলে না—এই তার প্রমাণ দেখ ” এই বলিয়৷ জয়ন্তী আপনি বেত উঠাইয়া দক্ষিণ হস্তে দৃঢ় মুষ্টিতে তাহা ধরিল, পরে সেই জনসমারোহসমক্ষে আপনার প্রফুল্লপদ্মসন্নিভ রক্তপ্রভ ক্ষুদ্র কর-পল্লব ক্তয়! সবলে তাহাতে বেত্ৰাঘাত করিল । বেত মাংস কাটিয়া উঠিল –হাতে রক্তের স্রোত বহিল ৷ জয়ন্তীর গৈরিকবস্ত্র এবং মঞ্চতল তাহাতে প্লাবিত হইল ! দেখিয়া লোকে হাহাকার করিতে লাগিল । i. জয়ন্তী মৃদু হাসিয়া চণ্ডালকে বলিল, “দেখিলে বাছা ! সন্ন্যাসীকে কি লাগে ? তোমার ভয় কি ?” চণ্ডাল একবার রুধিরাক্ত ক্ষত পানে চাহিল— একবার জয়ন্তীর সহান্ত প্রফুল্ল মুখপানে চাহিয়া দেখিল—দেখিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া আতি ত্রস্তভাবে মঞ্চসোপান অবরোহণ করিয়া, উৰ্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। লোকারণ্যমধ্যে সে কোথায় লুকাইল, কেহ দেখিতে পাইল না । রাজা তখন অনুচরবর্গকে আজ্ঞা “দোসর লোক লইয়া আইস—মুসলমান ।” অনুচরবর্গ, কালান্তক যমের সদৃশ এক জন কসাইকে লইয়া আসিল । সে মহম্মদপুরে গোরু করিলেন,