পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/২৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

... »8 অষ্টম পরিচ্ছেদ বিবি পাণ্ডব পরদিন রাধিলাম । সুভাষিণী দেখাইয়া দিতে আসিয়াছিল, আমি ইচ্ছা করিয়া সেই সময় লঙ্ক ফোড়ন দিলাম—সে কাসিতে কাসিতে উঠিয়া গেল,— বলিল, “মরণ আর কি ?” রান্না হইলে, বালক-বালিকার প্রথমে খাইল । স্বভাষিণীর ছেলে অন্ন ব্যঞ্জন বড় খায় না, কিন্তু স্বভাষিণীর পাঁচ বৎসরের একটি মেয়ে ছিল । সুভাষিণী তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন মান্না হয়েছে, হেমা ?” সে বলিল, “বেশ ! বেশ গে। বেশ !" মেয়েটি বড় শ্লোক বলিতে ভালবাসিত, সে আবার বলিল, “বেশ গো বেশ— রাধ বেশ, বাধ কেশ বকুল ফুলের মালা, রাঙ্গ সাড়ী, হাতে কঁাড়ি, রাধছে গোয়ালার বালা । এমন সময়, বাজল বঁাশী, কদম্বের তলে, কাদিয়ে ছেলে, রান্না ফেলে রাধুনী ছোটে জলে ” ম| ধমকাইল—“নে, শ্লোক রাখ, ।” চুপ করিল। তার পর রমণবাবু খাইতে বসিলেন । আড়াল হইতে দেখিতে লাগিলাম । দেখিলাম, তিনি সমস্ত ব্যঞ্জনগুলি কুড়াইয়া খাইলেন । গুহিণীর মুখে হাসি ধরে না রমণবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কে রেধেছে মা ?” গৃহিণী বলিলেন,"একটি নুতন লোক আসিয়াছে।” রামণবাবু বলিলেন, “রাধে ভাল ” এই বলিয়া তিনি হাত ধুইয়া উঠিয়া গেলেন। তার পর কৰ্ত্ত খাইতে বসিলেন । সেখানে আমি যাইতে পারিলাম না-গৃহিণীর আদেশমত বুড় বামুন ঠাকুরাণী কৰ্ত্তার ভাত লইয়। গেলেন। এখন বুঝিলাম, গৃহিণীর কোথায় ব্যথা, কেন তিনি সমন্তবয়স্ক স্ত্রীলোক রাখিতে পারেন না । প্রতিজ্ঞ করিলাম, ষত দিন এখানে থাকি, সে দিক মাড়াইব না। আমি সময়াস্তরে লোকজনের কাছে সংবাদ লইয়াছিলাম, কৰ্ত্তার কেমন চরিত্র । সকলেই জানিত, তিনি ভদ্রলোক—জিতেন্দ্ৰিয় । তবে কালির বোতলটার গলায় গলায় কালি । তখন মেয়ে বামন-ঠাকুরাণী ফিরিয়া আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, “কৰ্ত্তা রান্না খেয়ে কি বল্লেন ?” বামনী চটিয়া লাল, চেচাইয়া উঠিয়া বলিল, “ওগো, বেশ রেধেছ গো বেশ রেধেছ, আমরাও রাধিতে জানি, তা বুড়ো হ’লে কি আর দর হয় ? এখন রাধিতে গেলে রূপ যৌবন চাই ।” বুঝিলাম, কৰ্ত্ত খাইয়া ভাল বলিয়াছেন । কিন্তু, বামনীকে নিয়া একটু রঙ্গ করিতে সাপ হইল। বলিলাম, “ত। রূপ-যৌবন চাই বৈ কি বামন দিদি –পুড়ীকে দেখিলে কার খেতে রোচে ?” দাত বাহির করিয়া কৰ্কশ-কণ্ঠে বামনী বলিল, “তোমারই বুঝি রূপ-যৌবন থাকিবে ? মুখে পোকা পড়বে না ?” এই বলিয়া রাগের মাথায় একটা ঠাড়ি চড়াইতে গিয়া পাচিকা দেবী ষ্টাড়িটা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন । আমি বলিলাম, “দেখিলে দিদি ৷ রূপ-যৌবন না থাকিলে হাতের ছাড়ি ফাটে।" তখন ব্রাহ্মণী ঠাকুরাণী অৰ্দ্ধনগ্নাবস্থায় বেড়ি নিয়া আমাকে তাড়া করিয়া মারিতে আসিলেন । বয়োদোষে কাণে একটু খাটাে, ৰোধ হয়, আমার সকল কথা শুনিতে পান নাই । বড় কদৰ্য্য প্রত্যুত্তর করিলেন । আমারও রঙ্গ চড়িল । আমি বলিলাম, “দিদি, থামো । বেড়ি হাতে থাকিলেই ভাল ।” এই সময়ে সুভাষিণী সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল। বামনী রাগে তাহাকে দেখিতে পাইল ন। । আমাকে আবার তাড়াইয়া আসিয়৷ বলিল, “হারামজাদী ! য। মুখে আসে, তাই বলুবি ? বেড়ি আমার হাতে থাকিবে না ত কি পায়ে দেবে না কি ? আমি পাগল !” তখন সুভাষিণী ভ্রভঙ্গী করিয়া তাহাকে বলিল, “আমি লোক এনেছি তুমি হারামজাদী বলুবার কে ? তুমি বেরোও আমার বাড়ী থেকে ” তখন পাচিক শশবাস্তে বেড়ি ফেলিয়া দিয়া কাদকাদ হইয়। বলিল, “ও ম। সে কি কথা গো ! আমি কখন হারামজাদী বল্লেম ? এমন কথা আমি কখন মুখেও আনি নে ! তোমরা আশ্চৰ্য্য করিলে মা ।” - শুনিয়া স্বভাষিণী খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল । বামন ঠাকুরাণী তখন ডাক ছাড়িয়া-কাদিতে আরম্ভ করিলেন,—বলিলেন, “আমি যদি হারামজাদী ব’লে থাকি, তবে আমি যেন গোল্লায় যাই—” আমি বলিলাম, “বালাই ! ষাট ।” “আমি যেন যমের বাড়ী ষাই—”