পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবৃক্ষ এক স্থানে স্থায়ী নহেন ; সৰ্ব্বদা নানা স্থানে পর্য্যটন করিয়া বেড়ান । নগেন্দ্র । কবে আসিবেন, তাহা কেহ জানে ? রামকৃষ্ণ । তাহার কাছে আমার নিজেরও কিছু অবিশ্বক আছে। এ জন্য আমি সে কথারও তদন্ত করিয়াছিলাম। কিন্তু তিনি ষে কবে আসিবেন, তাহ কেহ বলিতে পারে না । নগেন্দ্র বড় বিষণ্ণ হইলেন । পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কত দিন এখান হইতে গিয়াছেন ?” রামকৃষ্ণ । তিনি শ্রাবণমাসে এখানে আসিয়াছিলেন । ভাদ্রমাসে গিয়াছেন । নগেন্দ্র। ভাল, এ গ্রামে হরিমণি বৈষ্ণবীর বাড়ী কোথায়, আমাকে কেহ দেখাইয়া দিতে পারেন ? রামকৃষ্ণ । হরিমণির ঘর পথের ধারেই ছিল । কিন্তু এখন আর সে ঘর নাই। সে ঘর আগুন লাগিয়া পুড়িয়া গিয়াছে। নগেন্দ্র আপনার কপাল টিপিয়া ধরিলেন। ক্ষীণ তর স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, "হরিমণি কোথায় আছে *" রামকৃষ্ণ । তাহাও কেহ বলিতে পারে না । মে রাত্রে তাহার ঘরে আগুন লাগে, সেই অবধি সে কোথায় পলাইয়া গিয়াছে । কেহ কেহ এমনও বলে যে, সে আপনার ঘরে আপনি অীগুন দিয়া পলাইয়াছে । নগেন্দ্র ভগ্নস্বর হইয়া কহিলেন, “তাহার ঘরে কোন স্ত্রীলোক থাকিত ?” রামকৃষ্ণ রায় কহিলেন, “না, কেবল শ্রাবণমাস হইতে একটি বিদেশী স্ত্রীলোক পীড়িত হইয়া আসিয়া তাহার বাড়ীতে ছিল । সেটিকে ব্ৰহ্মচারী কোথা হইতে " অনিয়া তাহার বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন। শুনিয়াছিলাম, তাহার নাম স্বৰ্য্যমুখী। স্ত্রীলোকটি কাসরোগগ্রস্ত ছিল,—আমিই তাহার চিকিৎসা করি। প্রায় আরোগ্য করিয়া তুলিয়াছিলাম—এমন সময়ে—” নগেন্দ্র হাপাইতে স্থাপাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন সময়ে কি—?” রামকৃষ্ণ বলিলেন, “এমন সময়ে হরবৈষ্ণবীর গৃহদাহে ঐ স্ত্রীলোকটি পুড়িয়া মরিল ।” নগেন্দ্রনাথ চৌকী হইতে পড়িয়া গেলেন। মস্তকে দারুণ আঘাত পাইলেন। সেই আঘাতে মূচ্ছিত হইলেন । কবিরাজ র্তাহার শুশ্রুষায় নিযুক্ত হইলেন। বাচিতে কে চাহে ? এ সংসার বিষময় । বিষবৃক্ষ সকলেরই গৃহপ্রাঙ্গণে । কে ভালবাসিতে চাহে ? (సి. অষ্টত্রিংশত্তম পরিচ্ছেদ । এত দিনে সব ফুরাইল এত দিনে সব ফুরাইল। সন্ধ্যাকালে যখন মগেন্দ্র দত্ত মধুপুর হইতে পান্ধীতে উঠিলেন, তখন এই কথা মনে মনে বলিলেন, “আমার এত দিনে সব ফুরাইল ।” কি ফুরাইল ? মুখ ? তা ত ষে দিন স্বৰ্য্যমুখী গৃহত্যাগ করিয়াছিলেন, সেই দিনই ফুরাইয়াছিল। তবে এখন ফুরাইল কি ? অাশা । যত দিন মানুষের আশা থাকে, ততদিন কিছুই ফুরায় না আশা ফুরাইলে সব ফুরাইল । নগেন্দ্রের আজ সব ফুরাইল । সেই জন্ত তিনি গোবিন্দপুর চলিলেন । গোবিন্দপুরে গৃহে বাস করিতে চলিলেন না ; গৃহধৰ্ম্মের নিকট জন্মের শোধ বিদায় লইতে চলিলেন । সে অনেক কাজ । বিষয়-আশয়ের বিলি-ব্যবস্থা করিতে হুইবে । জমীদারী, ভদ্রাসন-বাড়ী এবং অপরাপর স্বোপার্জিত স্থাবর সম্পত্তি ভাগিনেয় সতীশচন্দ্রকে দানপত্রের দ্বার। লিথিয়া দিবেন—সে লেখাপড়া উকীলের বাড়ী নহিলে হুইবে না। অস্থাবর সম্পত্তি সকল কমলমণিকে দান করিবেন—সে সকল গুছাইয়ু কলিকাতায় র্তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিতে হুইবে । কিছুমাত্র কাগজ আপনার সঙ্গে রাখিবেন—যে কয় বৎসর তিনি জীবিত থাকেন, সেই কয় বৎসর তাহাতেই র্তাহার নিজব্যয় নিৰ্ব্বাহ হইবে । কুন্দনন্দিনীকে কমলমণির নিকটে পাঠাইবেন । বিষয়-আশয়ের আয়ব্যয়ের কাগজপত্ৰসকল শ্ৰীশচন্দ্রকে বুঝাইয়া দিতে হইবে । আর স্বৰ্য্যমুখী যে খাটে শুইতেন, সেই খাটে শুইয়া একবার কাদিবেন। স্বৰ্য্যমুখীর অলঙ্কারগুলি লইয়া আসিবেন । সেগুলি কমলমণিকে দিবেন না—আপনার সঙ্গে রাখিবেন । যেখানে যাবেন, সঙ্গে লইয়া যাইবেন । পরে যখন সময় উপস্থিত হইবে, তখন সেইগুলি দেখিতে দেখিতে মরিবেন । এই সকল আবশুক কৰ্ম্ম নিৰ্ব্বাহ করিয়া, নগেন্দ্র জন্মের শোধ ভদ্রাসন ত্যাগ করিয়া পুনৰ্ব্বার দেশপর্য্যটন করিবেন। আর যত দিন বাচিবেন, পৃথিবীর কোথাও এক কোণে লুকাইয়া থাকিয়৷ দিনযাপন করিবেন। শিবিকারোহণে এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে নগেন্দ্র চলিলেন। শিবিক দ্বার মুক্ত, রাত্রি কাৰ্ত্তিকী জ্যোৎস্নাময়ী ; আকাশে তারা ; বাতাসে রাজপথিগাশ্বস্থ টেলিগ্রাফের তার ধ্বনিত হুইতেছিল।