পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৮৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুগলাঙ্গুরীয় 6: তৃতীয় পরিচ্ছেদ দুই বৎসরের পর আরও এক বৎসর গেল । তথাপি পুরন্দরের সিংহল হইতে আসার কোন সংবাদ পাওয়া গেল না। কিন্তু হিরণ্ডাষ্ট্রীর হৃদয়ে তাহার মূৰ্ত্তি পূৰ্ব্ববৎ উজ্জল ছিল। তিনি মনে মনে বুঝিলেন ষে, পুরন্দরও র্তাহাকে ভুলিতে পারেন নাই—নচেৎ এত দিন ফিরিতেন। এইরূপে দুই আর একে তিন বৎসর গেলে অকস্মাৎ এক দিন ধনদাস বলিলেন যে, "চল, সপরিবারে কাশী যাইব । গুরুদেবের নিকট হইতে র্তাহার শিষ্য আসিয়াছেন। গুরুদেব সে স্থানে যাইতে অনুমতি করিয়াছেন। তথায় হিরন্ময়ীর বিবাহ হুইবে । সেইখানে তিনি পাত্র স্থির করিয়াছেন।” ধনদাস, পত্নী ও কন্যাকে লইয়া কাশীযাত্র করিলেন। উপযুক্ত কালে কাশীতে উপনীত হইলে পর ধনদাসের গুরু আনন্দ স্বামী আসিয়া সাক্ষাৎ করিলেন এবং বিবাহের দিন স্থির করিয়া যথাশাস্ত্র উদ্যোগ করিতে বলিয়া গেলেন। বিবাহের যথাশাস্ত্র উদ্যোগ হইল ; কিন্তু ঘটা কিছুই হইল না, ধনদাসের পরিবারস্থ ব্যক্তি ভিন্ন কেহই জানিতে পারিল না যে, বিবাহ উপস্থিত । কেবল শাস্ত্রীয় আচার সকল রক্ষা করা হইল মাত্র । বিবাহের দিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হুইল—এক প্রহর রাত্রে লগ্ন, তথাপি গৃহে সচরাচর যাহারা থাকে, তাহারা ভিন্ন আর কেহই নাই। প্রতিবাসীরাও কেহ উপস্থিত নাই। এ পর্য্যন্ত ধনদাস ব্যতীত গৃহস্থ কেহই জানে না যে, কে পাত্ৰ—কোথাকার পাত্ৰ । তবে সকলেই জানিত ষে, যেখানে আনন্দ স্বামী বিবাহের সম্বন্ধ করিয়াছেন, সেখানে কখন আপাত্র স্থির করেন নাই । তিনি যে কেন পাত্রের পরিচয় ব্যক্ত করিলেন না, তাহ। তিনিই জানেন-ৰ্তাহার মনের কথা বুঝিবে কে ? একটি গৃহে পুরোহিত সম্প্রদানের উদ্যোগাদি করিয়া একাকী বসিয়া আছেন । বাহিরে ধনদাস একাকী বরের প্রতীক্ষা করিতেছেন । অস্তঃপুরে কন্যাসজ্জা করিয়া হিরন্ময়ী বসিয়া আছেন —আর কোথাও কেহ নাই । হিরন্ময়ী মনে মনে ভাবিতেছেন, "এ কি রহস্ত । কিন্তু পুরন্দরের সঙ্গে যদি বিবাহ ন হইল—তবে ষে হয়, তাহার সঙ্গে বিবাহ হউক।-সে আমার স্বামী হুইবে না ? এমন সময় ধনদাস কন্যাকে ডাকিতে আসিলেন । কিন্তু তাহাকে সম্প্রদানের স্থানে লইয়া যাইবার পূৰ্ব্বে বস্ত্রের দ্বারা তাহার দুই চক্ষু দৃঢ়ভর বাধিলেন। হিরণ্ময়ী কহিলেন, “এ কি পিতা ?” ধনদাস কহিলেন, *গুরুদেবের আজ্ঞা, তুমিও আমাদের আজ্ঞামত কার্য্য কর । মন্ত্রগুলি মনে মনে বলিও ” শুনিয়া হিরন্ময়ী কোন কথা কহিলেন না। ধনদাস দৃষ্টিহীন কন্যার হস্ত ধরিয়া সম্প্রদানের স্থানে লইয়া গেলেন । হিরন্ময়ী তথায় উপনীত হইয়। যদি কিছু দেখিতে পাইতেন, তাহা হইলে দেখিতেন ষে, পাত্রও র্তাহার ন্যায় আবৃতনয়ন । এইরূপে বিবাহ হইল । সে স্থানে গুরু, পুরোহিত এবং কন্যাকৰ্ত্ত ভিন্ন আর কেহ ছিল ন । বর-কন্যা কেহ কাহাকে দেখিলেন না, শুভদৃষ্টি হইল না। সম্প্রদানান্তে আনন্দ স্বামী বর-কন্যাকে কহিলেন যে, “তোমাদিগের বিবাহ হইল, কিন্তু তোমরা পরস্পরকে দেখিলে না। কন্যার কুমারী নাম ঘুচানই এই বিবাহের উদ্দেপ্ত, ইহজন্মে কখন তোমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হইবে কি না, বলিতে পারি না । যদি হয়, তবে কেহ কাহাকে চিনিতে পরিবে না । চিনিবার আমি একটি উপায় করিয়া দিতেছি । আমার হাতে দুইটি অঙ্গুরীয় আছে। দুইটি ঠিক এক প্রকার । অঙ্গুরীয় যে প্রস্তরে নিৰ্ম্মিত, তাহ পাওয়া যায় না এবং অঙ্গুরীয়ের ভিতরের পৃষ্ঠে একটি ময়ুর অঙ্কিত আছে । ইহার একটি বরকে, একটি কন্যাকে দিলাম। এরূপ অঙ্গুরীয় অন্য কেহ পাইবে না-বিশেষ এই ময়ূরের চিত্র অননুকরণীয়, ইহা আমার স্বহস্তে ক্ষোদিত। যদি কন্যা কোন পুরুষের হস্তে এইরূপ অঙ্গুরীয় দেখেন, তবে জানিবেন যে, সেই পুরুষ র্তাহার স্বামী, যদি বর কখন কোন স্ত্রীলোকের হস্তে এইরূপ অঙ্গুরীয় দেখেন, তবে জানিবেন যে, তিনি র্তাহার পত্নী । তোমরা কেহ এ অঙ্গুরীয় হারাইও না, বা কাহাকেও দিও না, অন্নাভাব হুইলেও বিক্রয় করিও না । কিন্তু ইহাও আজ্ঞা করিতেছি যে, অস্ত হইতে পঞ্চ বৎসরমধ্যে কদাচ এই অঙ্গুরীয় পরিও না । অদ্য আষাঢ় মাসের শুক্ল পঞ্চমীর রাত্রি একাদশ দণ্ড হইয়াছে, ইহার পর পঞ্চম আষাঢ়ের শুক্ল পঞ্চমীর একাদশ দণ্ড রাত্রি পর্যন্ত অঙ্গুরীয় ব্যবহার, নিষেধ করিলাম । আমার নিযেধ অবহেলা করিলে গুরুতর অমঙ্গল হইবে।” এই বলিয়া আনন্দ স্বামী বিদায় হইলেন। ধনদাস কন্যার চক্ষুর বন্ধন মোচন করিলেন । হিরন্ময়ী চাহিয়া দেখিলেন যে, গৃহমধ্যে কেবল পিতা ও পুরোহিত আছেন—তাহার স্বামী নাই। তাহার বিবাহ-রাত্রি একাই ষাপন করিলেন ।