পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/১৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ჯ) বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী চতুর্থ পরিচ্ছে বিবাহন্তে ধনদাস স্ত্রী ও কন্যাকে লইয়া দেশে ফিরিয়া আসিলেন। আরও চারি বৎসর অতিবাহিত হুইল । পুরনার ফিরিয়া আসিলেন না—হিরন্ময়ীর পক্ষে এখন ফিরিলেই কি, ন৷ ফিরিলেই কি ? পুরন্দর এই ষে সাত বৎসর ফিরিল না, ইহা ভাবিয়া হিরন্ময়ী দুঃখিত হষ্টলেন । মনে ভাবিলেন, “তিনি যে আজও আমায় ভুলিতে পারেন নাই বলিয়া আসিলেন না, এমত কদাচ সম্ভবে না। তিনি জীবিত আছেন কি ন সংশয় । তাহার দেখার আমি কামনা করি না, এখন আমি অন্তের স্ত্রী, কিন্তু আমার বাল্যকালের সুহৃৎ বাচিয়া থাকুন, এ কামনা কেন না করিব ?” ধনদাসের কোন কারণে না কোন কারণে চিন্তিতভাব প্রকাশ হইতে লাগিল, ক্রমে চিন্তা গুরুতর হইয়া শেষে দারুণ রোগে পরিণত হইল । তাহাতে র্তাহার মৃত্যু হইল । ধনদাসের পত্নী অমুম্ভ হইলেন । হিরণাস্ত্রীর আর কেহ ছিল না । এ জষ্ঠ হিরন্ময়ী মাতার চরণ ধারণ করিয়া অনেক রোদন করিয়া কহিলেন যে, “তুমি মরিও না।” কিন্তু শ্রেষ্টিপত্নী শুনিলেন না । তখন হিরন্ময়ী পৃথিবীতে একাকিনী হুইলেন । মৃত্যুকালে হিরন্ময়ীর মাতা তাহাকে বুঝাইয়াছিলেন যে, "বাছা, তোমার কিসের ভাবনা ? তোমার ”এক জন স্বামী অবশ্য আছেন । নিয়মিত কাল অতীত হইলে তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইলেও হইতে পারে। না হয়, তুমিও নিতান্ত বালিকা নহ । বিশেষ পৃথিবীতে ষে সহায় প্রধান—ধন—তাহ তোমার অতুল পরিমাণে রহিল।” কিন্তু সে আশা বিফল হইল-ধনদাসের মৃত্যুর পর দেখা গেল যে, তিনি কিছুই রাখিয়া ষান নাই। অলঙ্কার, অট্টালিকা এবং গার্হস্থ্য সামগ্ৰী ভিন্ন আর কিছুই নাই। অনুসন্ধানে হিরন্ময়ী জানিলেন যে, ধনদাস কয়েক বৎসর হইতে বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া আসিতেছিলেন । তিনি তাহা কাহাকে না বলিয়া শোধনের চেষ্টায় ছিলেন । ইহাই তাহার চিস্তার কারণ । শেষে শোধন অসাধ্য হইল। ধনদাস মনের ক্লেশে পীড়িত হইয়া পরলোকপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই সকল সংবাদ শুনিয়া অপরাপর শ্রেষ্ঠীর আসিয়া হিরণাস্ত্রীকে কহিল যে, “তোমার পিতা আমাদের ঋণগ্রস্ত হইয়া মরিয়াছেন। আমাদিগের ঋণ পরিশোধ কর । শ্রেঠিকন্ত। অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, তাহাদের কথা যথার্থ। তখন হিরণারী সৰ্ব্বস্ব বিক্রয় করিয়া তাহদের ঋণ পরিশোধ করি - লেন। বাসগৃহ পৰ্য্যন্ত বিক্রয় করিলেন । এখন হিরন্ময়ী অন্নবস্ত্রের দুঃখে দুঃখিনী হইয়া নগরপ্রান্তে এক কুটীরমধ্যে এক বাস করিতে লাগিলেন। কেবলমাত্র এক সহায় পরষহিতৈষী : অনিন্দ স্বামী, কিন্তু তিনি তখন দূরদেশে ছিলেন। হিরন্ময়ীর এমন একটি লোক ছিল না ষে, আনন্দ স্বামীর নিকট প্রেরণ করেন । পঞ্চম পরিচ্ছেদ হিরন্ময়ী যুবতী এবং সুন্দরী—একাকিনী এক গৃহে শয়ন করা ভাল নহে। আপদও আছে, কলঙ্কও আছে ; আমলা নামে এক গোপকন্ত হিরন্ময়ীর প্রতিবাসিনী ছিল। সে বিধবা, তাহার একটি কিশোরবয়স্ক পুল্ল এবং কয়েকটি কন্যা । তাহার যৌবনকাল অতীত হইয়াছিল। সচ্চরিত্রা বলিয়া খ্যাতি ছিল । হিরন্ময়ী রাত্রিতে আসিয়া তাহার গৃহে শয়ন করিতেন । এক দিন হিরন্ময়ী আমলার গৃহে শয়ন করিতে আসিলে পর আমল তাহাকে কহিল, “সংবাদ শুনিয়াছ, পুরন্দর শ্রেষ্ঠ না কি আট বৎসরের পর নগরে ফিরিয়া আসিয়াছে ?” শুনিয়া হিরন্ময়ী মুখ ফিরাইলেন –চক্ষুর জল অমলা না দেখিতে পায়। পৃথিবীর সঙ্গে হিরন্ময়ীর শেষ সম্বন্ধ ঘুচিল । পুরন্দর তাহাকে ভুলিয়া গিয়াছে ; নচেৎ ফিরিত না । পুরন্দর এক্ষণে মনে রাখুক বা ভুলুক, তাহার লাভ বা ক্ষতি কি ? তথাপি যাহার স্নেহের কথা ভাবিয়া যাবজ্জীবন কাটাইয়াছেন, সে ভুলিয়াছে, ভাবিতে হিরন্ময়ীর মনে কষ্ট হইল। হিরন্ময়ী একবার ভাবিলেন—“ভুলেন নাই, কত কাল আমার জন্ত বিদেশে থাকিবেন ? বিশেষ তাহাতে তাহার পিতার মৃত্যু হইয়াছে, আর দেশে না আসিলে চলিবে কেন ?”—আবার ভাবিলেন, “আমি কুলটা সন্দেহ নাই—নহিলে পুরন্দরের কথ। মনে করি কেন ?” অমল কহিল, “পুরন্দরকে কি তোমার মনে পড়িতেছে না ? পুরন্দর শচীসুত শ্রেষ্ঠীর ছেলে ?” ছি। চিনি । অ । তা সে ফিরে এসেছে—কত নৌকা ষে ধন এনেছে, তাহী গুণে সংখ্যা করা যায় না । - এত ধন না কি এ তামলিপে কেহ কখনও দেখে নাই ।