পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মৃণালিনী পলায়নের বৃত্তাস্ত শুনেন নাই । দিগ্বিজয় তদ্বিশেষ হেমচন্দ্রকে শুনাইল । হেমচন্দ্র কহিলেন, “নাগরিকের কি করিতেছে ?” দি । যে পারিতেছে, পলায়ন করিতেছে, যে ন পারিতেছে, সে প্রাণ হারাইতেছে । হে । আর গৌড়ীয় সেনা ? দি । কাহার জন্ত যুদ্ধ করিবে ? রাজা পলাতক । সুতরাং তাহারা আপন আপন পথ দেখিতেছে । হে । আমার আশ্বসজ্জা কর । দিগ্বিজয় বিস্মিত হইল, জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবেন ?” - হে । নগরে । দি । একাকী ? - হেমচন্দ্র ক্রকুট করিলেন, ক্রকুটি দেখিয় দিগ্বিজয় ভীত হইয়। অশ্বসজ্জা করিতে গেল । হেমচন্দ্র তখন মহামূল্য রণসজ্জায় সজ্জিত হইয়৷ সুন্দর অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন এবং ভীষণ শূলহস্তে নিঝরিণীপ্রেরিত জলবিম্ববত সেই অসীম ষবনসেনা-সমুদ্রে ঝাপ দিলেন । হেমচন্দ্র দেখিলেন, যবনের যুদ্ধ করিতেছে না, কেবল অপহরণ করিতেছে । যুদ্ধজন্য কেহই তাহাদিগের সম্মুখীন হয় নাই, সুতরাং যুদ্ধে তাহাদিগের ও মন ছিল না। যাহাদিগের অপহরণ করিতেছিল, তাহাদিগকেই অপহরণকালে বিনা যুদ্ধে ম।রিতেছিল । সুতরাং যবনের দলবদ্ধ হইয়া হেমচন্দ্রকে নষ্ট করিবার কোন উদ্যোগ করিল না । যে কোন যবন তৎকর্তৃক আক্রাস্ত হইয়া তাহার সহিত এক যুদ্ধোদ্যম করিল, সে তৎক্ষণাৎ মরিল । হেমচন্দ্র বিরক্ত হইলেন । তিনি যুদ্ধাকাঙ্ক্ষায় আসিয়াছিলেন, কিন্তু যবনের পূৰ্ব্বেই বিজয়লাভ করিয়াছে, অর্থসংগ্রহ ত্যাগ করিয়া তাহার সহিত রীতিমত যুদ্ধ করিল না। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “একটি একটি করিয়া গাছের পাতা ছিড়িয়া কে অরণ্যকে নিম্পত্র করিতে পারে ? একটি একটি ধবন মারিয়া কি করিব ? যবন যুদ্ধ করিতেছে না—যবনবধেই বা কি সুখ ? বরং গৃহীদের রক্ষার সাহায্যে মন দেওয়া তাল ।” হেমচন্দ্র তাহাই করিতে লাগিলেন, বিশেষ কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। দুই জন যবন তাহার সহিত যুদ্ধ করে, অপর যবনে সেই অবসরে গৃহস্থদিগের সর্বস্বাস্ত করিয়া চলিয়া যায়। যাহাই হউক, হেমচন্দ্র যথাসাধ্য পীড়িতের উপকার করিতে লাগিলেন । পথপাশ্বে এক কুটীরমধ্য হইতে হেমচন্দ্ৰ আৰ্ত্তনাদ শ্রবণ করিলেন। যবন কর্তৃক (t૭ আক্রাস্ত ব্যক্তির আর্তনাদ বিবেচনা করিয়া হেমচন্দ্র - গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন । দেখিলেন, গৃহমধ্যে যবন নাই। কিন্তু গৃহমধ্যে ' যবন-দৌরাত্ম্যের চিহ্ন সকল বিদ্যমান রহিয়াছে । দ্রব্যাদি প্রায় কিছুই নাই, ষাহ আছে, তাহার ভগ্নাবস্থা, আর এক ব্রাহ্মণ আহত অবস্থায় ভূমে পড়িয়া আৰ্ত্তনাদ করিতেছে । সে এ প্রকার গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে যে, মুত্যু আসন্ন । হেমচন্দ্রকে দেখিয়া সে যবনপ্রমে কহিতে লাগিল ;–“আইস– প্রহার কর—শীঘ্ৰ মরিব—মার –আমার মাথ৷ লষ্টয়৷ সেই রাক্ষসীকে দিও—আtঃ—প্রাণ যায়— জল ! জল ! কে জল দিবে ” হেমচন্দ্ৰ কহিলেন, “তোমার ঘরে জল আছে ?" ব্রাহ্মণ কাতরোক্তিতে কহিতে লাগিল, “জানি ন। -- মনে হয় না-জল ! জল ! পিশাচী !—সেই পিশাচীর জন্য প্রাণ গেল !” হেমচন্দ্র কুটারমধ্যে অন্বেষণ করিয়া দেখিলেন, এক কলসে জল আছে। পাত্রাভাবে পত্রপুটে তাহাকে জলদান করিল । ব্রাহ্মণ কছিলেন, “ন! ! না । জল খাইব ন! ! সবনের জল খাইব না।” হেমচন্দ্ৰ কহিলেন, “আমি যবন নহি, আমি হিন্দু —আমার হাতের জল পান করিতে পার । আমার কথায় বুঝিতে পারিতেছ না ?” ব্রাহ্মণ জল পান করিল । হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার আর কি উপকার করিব ?” ব্ৰাহ্মণ কহিল, “আর কি করিবে ? অার কি ? আমি মরি ! মরি ! ষে মরে, তাহার কি করিবে ?”. হেমচন্দ্ৰ কহিলেন, "তোমার কেহ আছে ? তাহাকে তোমার নিকট রাখিয়া যাইব ?” ব্রাহ্মণ কহিল, “আর কে—কে আছে ? ঢের আছে । তার মধ্যে সেই রাক্ষসী ! সেই রাক্ষসী— তাহাকে বলিও—বলিও—আমার—আপ—অপরাধের প্রতিশোধ হইয়াছে ” হেমচন্দ্র । কে সে ? কাহাকে বলিব ? ব্রাহ্মণ কহিতে লাগিল, “কে ?—সে—পিশাচী । পিশাচী চেন না ? পিশাচী, মৃণালিনী—মৃণালিনী । মৃণালিনী—পিশাচী ” ব্রাহ্মণ অধিকতর আর্তনাদ করিতে লাগিল— হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নাম শুনিয়া চমকিত হইলেন । জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃণালিনী তোমার কে হয় ?” ব্রাহ্মণ কহিলেন, “মৃণালিনী কে হয় ? কেছ না—আমার যম ।”