পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/২৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রজনী গোবিন্দকান্ত বাৰু বলিলেন, “ছ, আপনি কি প্রকারে জানিলেন ?” আমি বিশেষ কিছু বলিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, *হরেকৃষ্ণের শু্যালিপতির নাম কি ?” গোবিন্দ বাৰু বলিলেন, “রাজচন্দ্র দাস ৷” আমি । তাহার বা ড্রী কোথায় ? গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “কলিকাতায়, কিন্তু কোন স্থানে, তাহা অামি ভুলিয়া গিয়াছি ।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "সে কন্যাটির নাম কি জানেন ?” গোবিন্দ বাবু বলিলেন, “হরেকৃষ্ণ তাহার নাম রজনী রাখিয়াছিলেন ।” ইহার অল্পদিন পরেই আমি কাশী পবিত্যাগ করিলাম । তৃতীয় পরিচ্ছেদ প্রথমে আমাকে বুঝিতে হইতেছে, আমি কি খুজি । চিত্ত আমার দুঃখময়, এ সংসার আমার পক্ষে অন্ধকার। আজি আমার মৃত্যু হইলে, আমি কাল চাহি না । যদি দুঃখনিবারণ করিতে না পারিলাম, তবে পুরুষত্ব কি ? কিন্তু ব্যাধির শান্তি করিতে গেলে আগে ব্যাধির নির্ণয় চাহি, দুঃখনিবারণের আগে আমার দুঃখ কি, তাহ নিরূপণের আবশুক । দুঃখ কি ? অভাব । সকল দুঃখই অভাব । রোগ দুঃখ, কারণ, রোগ স্বাস্থ্যের অভাব । অভাবমাত্রই দুঃখ নহে, তাহ জানি । রোগের অভাব দুঃখ নহে । অভাববিশেষই দুঃখ । আমার কিসের অভাব ? আমি চাই কি ? মনুষ্যই বা কি চায় ? ধন ? অামার যথেষ্ট আছে । যশ ? পৃথিবীতে এমন কেহ নাই—যাহার ষশ নাই । যে পাকা জুয়াচোর, ভাহারও বুদ্ধি সম্বন্ধে যশ আছে । আমি এক জন কশাইয়েরও ষশ শুনিয়াছি —মাংস সম্বন্ধে সে কাহাকেও প্রবঞ্চনা করিত না । সে কখন মেঘমাংস বলিয়া কাহাকেও কুকুরমাংস দেয় নাই । যশ সকলেরই আছে । আবার কাহারও যশ সম্পূর্ণ নহে। বেকনের ঘুষখোর অপবাদ– মক্রেতিস অপষণ হেতু বধদণ্ডাৰ্থ হইয়াছিলেন। যুধিষ্ঠির দ্রোণবধে মিথ্যাবাদী, অর্জুন বক্রবাহন কর্তৃক পরাভূত। কাইসরকে যে বিধানিয়ার রাণী বলিত, সে কথা অদ্যাপি প্রচলিত ;-সেক্ষপীয়রকে বলটের ভাড় বলিয়াছিলেন । ষশ চাহি না । Sዓ যশ সাধারণ লোকের মুখে । সাধারণ লোক কোন বিষয়ের বিচারক নহে—কেন না, সাধারণ লোক মূর্থ এবং স্থূলবুদ্ধি। মুর্গ ও স্থলবুদ্ধির কাছে যশস্বী হইয়া আমার কি সুখ হুইবে ? আমি স্বশ চাহি না । মান ? সংসারে এমন লোক কে আছে যে, সে মানিলে সুখী হই ? যে দুই চারি জন আছে, তাহাদিগের কাছে আমার মান আছে । অস্তের কাছে মান—অপমান মাত্র । রাজদরবারে মান— সে কেবল দাসত্বের প্রাধান্ত-চিহ্ন বলিয়া আমি অগ্রাহ করি । আমি মান চাহি না । মান চাহি কেৰল আপনার কাছে । - রূপ ? কতটুকু চাই ? কিছু চাই । লে দেখিয় না নিষ্ঠীবন ত্যাগ করে । আমাকে দেখিয়া কেহ নিষ্ঠীবন ত্যাগ করে না। রূপ যাহা অাছে, তাহাই আমার যথেষ্ট । স্বাস্থ্য ? অামার স্বাস্থ্য অদ্যাপি অনস্ত । বল ? লইয়া কি করিব ? প্রহার করিতে বল আবিষ্ঠক । আমি কাহাকেও প্রহার করিতে চাহি নী । বুদ্ধি ? এ সংসারে কেহ কখন বুদ্ধির অভাব আছে মনে করে নাই—আমিও করি না । সকলেই আপনাকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলিয়া জানে, আমিও জানি । বিদ্যা ? ইহার অভাব স্বীকার করি, কিন্তু কেহ কখন বিদ্যার অভাবে আপনাকে অমুখী মনে করে নাই । আমিও করি না । ধৰ্ম্ম ? লোকে বলে ধৰ্ম্মের অভাব পরকালের দুঃখের কারণ, ইহকালের নহে । লোকের চরিত্রে দেখিতে পাই, অভাবই দুঃখ । জানি আমি সে মিথ্যা, কিন্তু জানিয়াও ধৰ্ম্মকামনা করি না। আমার সে দুঃখ নহে। প্রণয় ? স্নেহ ? ভালবাসা ? আমি জানি, ইহার অভাবই মুখ-ভালবাসাই দুঃখ ৷ সাক্ষী লবঙ্গলতী । তবে আমার দুঃখ কিসের ? আমার অভাব কিসের ? অামার কিসের কামনা যে, তাহ লাভে সফল হইয়া দুঃখ নিবারণ করিব ? আমার কাম্যবস্তু কি ? বুঝিয়াছি । আমার কাম্যবস্তুর অভাবই আমার দুঃখ । আমি বুঝিয়াছি ষে, সকলই অসার, কাষ্ট আমার কেবল দুঃখ সার ।