পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ রে জান্‌, আয় " বলিয়া পিসী কন্যাকে কোলে তুলিয়া লইল । কন্যা সম্বন্ধে এইরূপ বন্দোবস্ত হইলে, মাণিকলাল নিশ্চিন্তচিত্তে গ্রাম হইতে নিৰ্গত হইল । কাহাকেও কিছু না বলিয়া রূপনগরে যাইবার পাৰ্ব্বত্যপথে আরোহণ করিল। - মাণিকলাল এইরূপ বিচার করিতেছিল—“ঐ অধিত্যকায় অনেকগুলি অশ্বারোহী আসিয়াছিল কেন ? ঐখানে রাণাও একাকী ভ্ৰমিতেছিলেন--কিন্তু উদয় পুর হইতে এত দুর রাণা একাকী আসিবার সম্ভাবনা নাই। অতএব উহার রাণার, সমভিব্যাহারী অশ্বরোহী। তার পর দেখা গেল, উহার উত্তর হইতে আসিয়াছে—উদয়পুর অভিমুখে যাইতেছিল—বোধ হয়, রাণ মৃগয়া বা বনবিহারে গিয়া থাকিবেন, উদয়পুর ফিরিয়া যাইতেছিলেন। তার পর দেখিলাম, উহার উদয়পুর যায় নাই। উত্তরমুখেই ফিরিয়াছে কেন ? উত্তরে ত রূপনগর বটে। বোধ হয়, চঞ্চলকুমারীর পত্র পাইয়। রাণী অশ্বারোহী সৈন্ত সমভিব্যাহারে তাহার নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়াছেন । তাহা যদি না গিয়া থাকেন, তবে তাহার রাজপুতপতি নাম মিথ্যা । আমি তাহার ভূতা—আমি তাহার কাছে যাইব-–কিন্তু তাহারা অশ্বারোহণে গিয়াছেন— আমার পদব্ৰজে যাইতে অনেক বিলম্ব হইবে । তবে এক ভরসা, পাৰ্ব্বত্য পথে অশ্ব তত দ্রুত যায় না এবং মাণিকলাল পদব্রজে বড় দ্রুতগামী । মাণিকলাল দিবারাত্র পথ চলিতে লাগিল ৷ যথাকালে সে রূপনগরে পৌছিল । পৌঁছিয়া দেখিল যে, রূপনগরে দুই সহস্ৰ মোগল অশ্বারোহী আসিয়া শিবির করিয়াছে, কিন্তু রাজপুত সেনার কোন চিহ্ন দেখা যায় না । আরও শুনিল, পরদিন প্রভাতে মোগলের রাজকুমারীকে লষ্টয়। যাইবে । মাণিকলাল বুদ্ধিতে একটি ক্ষুদ্র সেনাপতি । রাজপুতগণের কোন সন্ধান না পাইয়া, কিছুই দুঃখিত হইল না। মনে মনে বলিল, “মোগল পারিবে না— কিন্তু আমি প্রভুর সন্ধান করিয়া লইব ।” এক জন নাগরিককে মাণিক বলিল, “আমাকে দিল্লী যাইবার পথ দেখাইয়া দিতে পার ? আমি কিছু বখ শিস দিব।” নাগরিক সম্মত হইয়া কিছু দুর অগ্রসর হইয় তাহাকে পথ দেখাইয়া দিল । মাণিকলাল তাহাকে পুরস্কৃত করিয়া বিদায় করিল। পরে দিল্লীর পথে, চারিদিক্‌ ভাল করিয়া দেখিতে দেখিতে চলিল। মাণিকলাল স্থির করিয়াছিল যে, রাজপুত্ত অশ্বারোহিগণ অবশু দিল্লীর পথে কোথাও •ඵ( লুকাইম্বা আছে । প্রথমতঃ কিছু দূর পর্য্যস্ত মাণিক লাল রাজপুতসেনার কোন চিহ্ন পাইল না । পরে এক স্থানে দেখিল, পথ অতি সঙ্কীর্ণ হইয়া আসিল । দুই পাশ্বে দুইটি পাহাড় উঠিয়া, প্রায় অৰ্দ্ধক্রোশ সমান্তরাল হইয়া চলিয়াছে—মধ্যে কেবল সঙ্কীর্ণ পথ । দক্ষিণদিকের পর্বত অতি উচ্চ—এবং দুরারোহণীয়— তাহার শিখরদেশ প্রায় পথের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। বামদিকে পৰ্ব্বত অতি ধীরে ধীরে উঠিয়াছে । আরোহণের সুবিধা এবং পৰ্ব্বতও অনুচ্চ । এক স্থানে ঐ বামদিকে একটি রঞ্জ বাহির হইয়াছে, তাহা দিয়া একটু স্থল্ম পথ আছে। নাপোলিয়ন প্রভৃতি অনেক দস্থ্য সুদক্ষ সেনF পতি ছিলেন । রাজা হইলে লোকে আর দমু্য বলে নী । মাণিকলাল রাজা নহে—সুতরাং আমরা তাহাকে দস্থ্য বলিতে বাধ্য। কিন্তু রাজদসু্যদিগের ন্যায় এই ক্ষুদ্র দস্থ্যরও সেনাপতির চক্ষু ছিল । পৰ্ব্বতনিরুদ্ধ সঙ্কীর্ণ পথ দেখিয়া সে মনে করিল, রাণী যদি আসিয়া থাকেন, তবে এইখানেই আছেন । যখন মোগল সৈন্ত এই সঙ্কীর্ণ পথ দিয়া যাইবে—এই পৰ্ব্বতশিখর হইতে রাজপুত অশ্ব বজের ন্যায় তাহাদিগের মস্তকে পড়িতে পারিবে । দক্ষিণদিকের পর্বত দুরারোহণীয় ; অশ্বারোহিগণের আরোহণ ও অবতরণের অনুপযুক্ত ; অতএব সেখানে রাজপুতসেনা থাকিবে নী—কিন্তু বামের পর্বত হইতে তাহাদিগের অবতরণের বড় সুখ । মাণিকলাল তদুপরি আরোহণ করিল। তখন সন্ধ্যা হইয়াছে । উঠিয়া কোথাও কাহাকেও দেখিতে পাইল না । মনে করিল, খুজিয়া দেখি ; কিন্তু আবার ভাবিল, রাজা ভিন্ন আর কোন রাজপুত আমাকে চিনে না, আমাকে মোগলের চর বলিয়া হঠাৎ কোন অদৃশু রাজপুত মারিয়া ফেলিতে পারে। এই ভাবিয়া সে আর অগ্রসর না হইয়া, সেই স্থানে দাড়াইয়া বলিল, “মহারাণার জয় হউক ” এই শব্দ উচ্চারিত হইবামাত্র চারি পাচ জন শস্ত্রধারী রাজপুত অদৃশু স্থান হইতে গাত্ৰোখান করিয়া দাড়াইল এবং তরবারিহস্তে মাণিকলালকে কাটিতে আসিতে উদ্যত হুইল । এক জন বলিল, “মারিও না ।” মাণিকলাল দেখিল, স্বয়ং রাণী । রাণী বলিলেন, “মারিও না । এ আমাদিগের স্বজন।” যোদ্ধগণ তখনই আবার লুক্কায়িত হইল । রাণা মাণিককে নিকটে আসিতে বলিলেন, সে নিকটে আসিল। এক নিভৃত স্থলে তাহাকে বসিতে