পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (প্রথম ভাগ).djvu/৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজসিংহ অতএব, হিন্দু, শক্রকেও সহজে উপবাসে মারিতে চাহে না । সন্ধ্যার পর শিবিরে রাজসভা সমবেত হইল । তথা প্রধান সেনাপতিগণ, প্রধান রাজমন্ত্রিগণ উপস্থিত হইলেন। রাজমন্ত্ৰিগণের মধ্যে প্রধান দয়াল সাহা । তিনিও উপস্থিত ছিলেন । মাণিকলালও ছিল। রাজসিংহ বিচাৰ্য্য বিষয়টা সকলকে বুঝাইয়া দিয়া, সভাসদগণের মভ জিজ্ঞাসা করিলেন । অনেকেই বলিলেন, “মোগল ঐখানে ক্ষুধাতৃষ্ণায় মরিয়া পচিয়া থাকুক-ঔরঙ্গজেবের বেটাকে ধরিয়া আনিয়া উহাদের গোর দেওয়াইব । না হয়, দোসাদের দল আনিয়া মাটী চাপা দেওয়াইব । মোগল হইতে বার বার রাজপুতের যে অনিষ্ট ঘটিয়াছে, তাহা স্মরণ করিলে কাহারও ইচ্ছা হইবে না যে, মোগলকে হাতে পাইয়া ছাড়া যায় ।” ইহার উত্তরে মহারাণ। বলিলেন, “না হয় স্বীকার করিলাম যে, এই মোগলদিগকে এইখানে শুকাইয়া মারিয়া মাটী চাপা দেওয়া গেল । কিন্তু ঔরঙ্গজেব আর ঔরঙ্গজেবের উপস্থিত সৈন্তগণ মরিলেই মোগল নিঃশেষ হইল না। ঔরঙ্গজেব মরিলে শাহ আলম্ বাদশাহ হইবে । শাহ আলমের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যবিস্ময়ী মহাসৈন্য পৰ্ব্বতের অপর পারে সশস্ত্রে উপস্থিত আছে। আর দুইটা মোগলসেন আর দুইদিকে বসিয়া আছে । আমরা কি এই সকলগুলিকে নিঃশেষ ধ্বংস করিতে পারিব ? যদি না পারি, তবে অবশ্য একদিন সন্ধিস্থাপন করিতে হইবে। যদি সন্ধি করিতে হয়, তবে এমন সুসময় আর কবে হইবে ? এখন ঔরঙ্গজেবের প্রাণ কণ্ঠাগত—এখন তাহার কাছে যাহ। চাহিব, তাহাই পাইব । সময়ান্তরে কি তেমন পাইব ?” দয়াল সাহা বলিলেন, “নাই পাইলাম । তবু এই মহাপাপিষ্ঠ পৃথিবীর কণ্টকস্বরূপ ঔরঙ্গজেবকে বধ করিলে পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করা হইবে । এমন পুণ্য আর কোন কার্য্যে নাই । মহারাজ ! মতান্তর করিবেন না ।” রাজসিংহ বলিলেন, “সকল মোগল বাদশাহুই দেখিলাম—পৃথিবীর কণ্টক । ঔরঙ্গজেব শাহজাহার অপেক্ষাও কি নরাধম ? খক্ষ হইতে আমাদের ষত অমঙ্গল ঘটিয়াছে, ঔরঙ্গজেব হইতে কি তত হইয়াছে ? শাহ আলম যে পিতৃপিতামহ হইতেও দুরাচার না হইবে, তাহার স্থিরতা কি ? আর তোমরা যদি এমন ভরসাই কর-সে ভরসা আমিও না করি, তা নয়—যে, এই চারিটি মোগল সেনাই আমরা পরাজিত করিতে পারিব, তবে ভাবিয়া দেখ, సె$ কত অসংখ্য মনুষ্য হত্যার পর সে অাশা ফলে পরিণত হইবে। কত অসংখ্য রাজপুত বিনষ্ট হইবে। অবশিষ্ট থাকিবে কয় জন ? আমরা অল্পসংখ্যক ; মুসলমান বহুসংখ্যক । আমরা সংখ্যায় কমিয়া গেলে, আবার যদি মোগল আসে, তবে কার বাহুবলে তাদের আবার তাড়াইব ?” দয়াল সাহা বলিল, “মহারাজ, সমস্ত রাজপুতানা একত্রিত হইলে মোগলকে সিন্ধু পার করিয়া রাখিয়া আসিতে কতক্ষণ লাগে ?” রাজসিংহ বলিলেন, “সে কথা সত্য । কিন্তু তাহা কখন হইয়াছে কি ? এখনও ত সে চেষ্টা করিতেছি —ঘটিতেছে কি ? তবে সে ভরসা কি প্রকারে করিব ?” দয়াল সাহা বলিলেন, “সন্ধি হইলেও ঔরঙ্গজেব সন্ধিরক্ষা করিবে, এমন ভরসা করি না । আমন মিথ্যাবাদী, ভণ্ড কখনও জন্মগ্রহণ করে নাই । মুক্তি পাইলেই সে সন্ধিপত্র ছিড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, যা করিতেছিল, তাহাই করিবে ।” রাজসিংহ বলিলেন, “তা ভাবিলে কখনই সন্ধি করা হয় না । তাই কি মত?” এইরূপ অনেক বিচার হইল। পরিশেষে সকলেই রাণার কথার যাথার্থ্য স্বীকার করিলেন । সন্ধিস্থাপনের কথাই স্থির হইল । - তখন কেহ আপত্তি করিল, “ঔরঙ্গজেব ত কৈ সন্ধির চেষ্টায় দূত পাঠান নাই । তার গরজ, নী আমাদের গরজ ?” তাহাতে রাজসিংহ উত্তর করিলেন, “দূত আসিবে কি প্রকারে ? সে রন্ধ্রপথের ভিতর হইতে একটি পিপড়া উপরে আসিবার পথ রাখি নাই ।” দয়াল সাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে আমাদেরই বা দূত যাইবে কি প্রকারে ? সেবার ঔরঙ্গজেব আমাদিগের দূতকে বধ করিবার আজ্ঞা দিয়াছিল। এবার যে সে আজ্ঞা দিবে না, তার ঠিকানা কি ?” রাজসিংহ বলিলেন, "এবার যে বধ করিবে না, তাহী স্থির । কেন না, এখন কপট সন্ধিতেও তাহার. মঙ্গল । তবে দূত সেখানে যাইবে কি প্রকারে, তাহার গোলযোগ আছে বটে ।” তখন মাণিকলাল নিবেদন করিল, “সে ভার আমার উপর অর্পিত হউক । আমি মহারাণার পত্র ঔরঙ্গজেবের নিকট পৌছাইয়া দিব, এবং উত্তর আনিয়া দিব ।” - সকলেই সে কথায় বিশ্বাস করিল, কেন না, সকলেই জানিত, কৌশলে ও সাহসে মাণিকলাল