পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/২৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰবন্ধ-ভারত-কলঙ্ক যাইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। সত্য বটে, এক্ষণকার কাবাল রাজ্যের অধিকাংশ পািব্বকালে হিন্দ,রাজ্যভুক্ত ছিল, কিন্তু সে প্রদেশ তৎকালে ভারতবর্ষের একাংশ বলিয়া গণ্য হইত। প্রাচীন হিন্দীদিগের এ কলঙ্কের তৃতীয় কারণ-হিন্দরা বহদিন হইতে পরাধীন। যে জাতি বহকাল পরাধীন, তাহাদিগের আবার বীরগৌরব কি ? কিন্তু এক্ষণকার হিন্দীদিগের বীৰ্য্য-লাঘব, প্রাচীন হিন্দীদিগের অবমাননার উপযক্ত কারণ নহে। প্রায় অনেক দেশেই দেখা যায় যে, প্রাচীন এবং আধনিক লোকের মধ্যে চরিত্রগত সাদশ্য অধিক নহে। ইটালি ও গ্রীস, ভারতবর্ষের ন্যায়। এই কথার উদাহরণস্থল। মধ্যকালিক ইটালীয়, এবং বৰ্ত্তমান গ্রীকদিগের চরিত্র হইতে প্রাচীন রোমক ও গ্রীকদিগকে কাপােরষি বলিয়া সিদ্ধ করা যােদশ অন্যায়, আধনিক ভারতবষীয়দিগের পরাধীনতা হইতে প্রাচীন দিগের বললাঘব সিদ্ধ করা তাদশ অন্যায়। আমরা এমতও বলি না যে, আধনিক ভারতবষীয়েরা নিতান্ত কাপরিষ, এবং সেই জন্য এতকাল পরাধীন। এ পরাধীনতার অন্য কারণ আছে। আমরা তাহার দাইটি কারণ সবিস্তারে এ স্থলে নিদিষ্ট করি। প্রথম, ভারতবষীয়েরা সর্বভাবতই স্বাধীনতার আকাঙক্ষারহিত। সর্বদেশীয়, সবজাতীয় লোকে আমাদিগকে শাসিত করােক, পরজাতীয়দিগের শাসনাধীন হইব না, এরপ অভিপ্ৰায় ভারতবষীয়দিগের মনে আইসে না। সবজাতীয়ের রাজ্যশাসন মঙ্গলকর বা সখের আকার, পরজাতীয়ের রাজদণ্ডড পীড়াদায়ক বা লাঘবের কারণ, এ কথা তাহদের বড় হৃদয়সঙ্গত নহে। পরতন্ত্রতা অপেক্ষা সর্বতন্ত্রতা ভাল, এরপ একটা তাহাদিগের বোধ থাকিলে থাকিতে পারে, কিন্তু সেটি বোধমাত্ৰ-সে জ্ঞান আকাঙ্ক্ষায় পরিণত নহে। অনেক বস্তু আমাদিগের ভাল বলিয়া জ্ঞান থাকিতে পারে, কিন্তু সে জ্ঞানে তৎপ্রতি সকল স্থানে আকাঙ্ক্ষা জন্মে না। কে না। হরিশচন্দ্রের দাতৃত্ব বা কাশিয়সের দেশবাৎসল্যের প্রশংসা করে ? কিন্তু তাহার মধ্যে কয়জন হরিশচন্দ্রের ন্যায়। সব্বত্যাগী বা কাশিয়সের ন্যায় আত্মঘাতী হইতে প্ৰস্তৃত ? প্রাচীন বা আধনিক ইউরোপীয় জাতীয়দিগের মধ্যে সর্বাতন্ত্র্যপ্রয়তা বলবতী আকাঙক্ষায় পরিণত। তাঁহাদিগের বিশ্বাস যে, সর্বতন্ত্রতা ত্যাগের অগ্ৰে প্ৰাণ এবং সব্বস্ব ত্যাগ কৰ্ত্তব্য। হিন্দদের মধ্যে তাহা নহে। তাঁহাদিগের বিবেচনা “যে ইচ্ছা রাজা হউক, আমাদের কি ?” সৰবজাতীয় রাজা, পরজাতীয় রাজা, উভয় সমান। সবজাতীয় হউক, পরজাতীয় হউক, সীশাসন করিলে দাই সমান। সবজাতীয় রাজা সশাসন করিবে, পরজাতীয় সশাসন করিবে না, তাহার স্থিরতা কি ? যদি তাহার স্থিরতা নাই, তবে কেন সবজাতীয় রাজার জন্য প্ৰাণ দিব ? রাজ্য রাজার সম্পত্তি। তিনি রাখিতে পারেন রােখন। আমাদিগের পক্ষে উভয় সমান। কেহই আমাদিগের ষািঠ ভাগ ছাড়িবে না, কৃষ্ণু দারুকে পরস্তুত করবে না। যে রাজা হয় হউক, আমরা কাহারও জন্য অঙ্গলি ক্ষত রব না। ক্ষ আমরা এক্ষণে সবাতন্ত্র্যপর ইংরেজীদিগের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া এই সকল কথার ভ্রম দেখিতে পাইতেছি। কিন্তু ইহা অস্বাভাবিক নহে, এবং ইহার ভ্রান্তি সহজে অন মেয়ও নহে। সর্বভাব্যবশতঃ কোন জাতি অসভ্যকাল হইতেই সর্বাতন্ত্র্যাপ্রিয়; সর্বভাব্যবশতঃ কোন জাতি সসভ্য হইয়াও তৎপ্রতি আস্থাশন্য। এই সংসারে অনেকগালিন সপাহনীয় বস্তু আছে; তন্মধ্যে সকলেই সকল বস্তুর জন্য যত্নবান হয় না। ধন এবং যশঃ উভয়েই পাহনীয়। কিন্তু আমরা সচরাচর দেখিতে পাই, এক ব্যক্তি ধনসগুয়েই রত, যশের প্রতি তাহার অনাদর; অন্য ব্যক্তি যশোলিপস, ধনে হতাদর। রাম ধনসম্প্রচয়ে একৱত হইয়া কাপণ্য, নীচাশয়তা প্রভৃতি দোষে যশোহানি করিতেছে; যদি অমিত ধনরাশি নম্পন্ট করিয়া দাতৃত্বাদি গণে যশঃ সঞ্চয় করিতেছে। রাম ভ্রান্ত,

  • আমরা এমত বলি না যে, ভারতবর্ষে কখন কোন স্বাতন্ত্র্যভুক্ত জাতি ছিল না। মীবাররাজপতিদিগের অপব্ব কাহিনী যাঁহারা টডের গ্রন্থে অবগত হইয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, ঐ রাজপতিগণ হইতে সবাতন্ত্র্যোন্মত্ত জাতি কখন পথিবীতে দেখা দেয় নাই। সেই সবাতন্ত্ৰাপ্রিয়তার ফলও চমৎকার। মীবার ক্ষদ্র রাজ্য হইয়াও ছয় শত বৎসর। পৰ্যন্ত মসলমান সাম্রাজ্যের মধ্যস্থলে স্বাধীন হিন্দ রাজপতাকা উড়াইয়াছে। আকবর বাদাসাহের বাহবলও মীবার ধ্বংসে সক্ষম হয় নাই। অদ্যাপি উদয়পরের রাজবংশ পথিবীর মধ্যে প্রাচীন রাজবংশ বলিয়া বিখ্যাত। কিন্তু এক্ষণে আর সে দিন নাই। সে রামও নাই, সে অযোধ্যাও নাই। উপরে আমরা যাহা বলিয়াছি, তাহা সাধারণ হিন্দ সম্পবন্ধে যথাৰ্থ।

ROC