পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৩৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিম রচনাবলী করিবেন ইচ্ছা। পত্রিকে ভুলাইবার জন্য তাঁহার এক শত মহিষী করিয়া দিলেন, কিন্তু পত্র ভুলিল না। তখন মাতা পত্রিকে ধৰ্ম্মে মতি দিতে লাগিলেন। এইবার পত্র ভুলিয়া, যোগ্যধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়া, বনে গমন করিলেন। গোপীচন্দ্রের পর তাঁহার পত্র ভবচন্দ্র রাজা হইলেন। পাঠক হবচন্দ্র রাজা, গবচন্দ্ৰ পাত্রের কথা শনিয়াছেন ? এই সেই হবচন্দ্র ? নাম হবচন্দ্র নয়-ভবচন্দ্র, আর একটি নাম উদয়চন্দ্র। ভবচন্দ্ৰ গিবচলেদুর বদ্ধিবিদ্যার পরিচয় লোকপ্রবাদে এত আছে যে, তাহার পনেরক্তি না করিলেও হয়। লোকে গল্প করে, গবচন্দ্র, বদ্ধি বাহির হইয়া যাইবে ভয়ে, চিপলে দিয়া নাক কাণ বন্ধ করিয়া রাখতেন। তাহাতেও সন্তুষ্ট নন, পাছে বদ্ধি বাহির হইয়া যায়। ভয়ে সিন্ধ-কে গিয়া লকাইয়া থাকিতেন, রাজার কোন বিপদৰ আপদত পড়িলে, সিন্ধক হইতে বাহির হইয়া, নাক কাণের পাটলি খালিয়া বদ্ধি বাহির করিতেন। একদিন রাজার এইরহপ এক বিপদ উপস্থিত, নগরে একটা শােকর দেখা দিয়াছে। শােকর রাজসমীপে আনীত হইলে, রাজা কিছই স্থির করিতে পারিলেন না যে, এ কি জন্তু। বিপদৰ আশঙ্কা করিয়া মন্ত্রীকে সিন্ধক হইতে বাহির করিলেন। মন্ত্রী ঢিপলে খলিয়া অনেক চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন, এটা অবশ্য হস্তী, না খাইয়া রোগা হইয়াছে, নচেৎ ইন্দর, খাইয়া বড মোটা হইয়াছে। আর একদিন দাই জন পথিক আসিয়া সায়াহ্নে এক পঙ্করিণীতীরে উত্তীণ হইল। রাত্রে পাকশাক করিবার জন্য সরোবরতীরে স্থান পরিস্কার করিয়া চুলা কাটিতে আরম্ভ করিল। নগরের রক্ষিবাগ দেখিয়া মনে করিল যে যখন পাকুর থাকিতেও তার কাছে আবার খানা কাটিতেছে, তখন অবশ্য ইহাদের অসৎ অভিপ্ৰায় আছে। রক্ষিগণ পথিক দই জনকে গ্রেপ্তার করিয়া রাজসন্নিধানে লইয়া গেল। রাজা সবিয়ং সিন্ধকের ভিতর হইতে বাহির করিলেন। তিনি নাক কাণের ঢিপিলে খালিয়াই দিব্যচক্ষে কাণডোখানা দাপণের মত পরিস্কার দেখিলেন। তিনি আজ্ঞা করিলেন, “নিশ্চিত ইহারা চোর ! পাকুরটা চুরি করিবার জন্য পাড়ের উপর সিদ্ধ কাটিতেছিল। ইহাদিগকে শহলে দেওয়া বিধেয়।” রাজা ভবচন্দ্ৰ, মন্ত্রীর বদ্ধিপ্রাখয্যে মন্বন্ধ হইয়া তৎক্ষণেই পঙ্করিণীচেরদ্বয়ের প্রতি শহলে যাইবার বিধি প্রচার করিলেন। কথা এখনও ফরায় নাই। পাকুরচোরেরা শহলে যাইবার পর্বে পরামর্শ করিয়া হঠাৎ পরস্পর ঠেলা ঠেলি মারামারি আরম্ভ করিল। রাজা ও রাজমন্ত্রী এই বিচিত্ৰ কাণত্ড দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ব্যাপার কি? তখন একজন চোর নিবেদন করিল যে, “হে মহারাজ ! দেখান, দই শিলের মধ্যে একটি বড়, একটি ছোট। আমরা জ্যোতিষ জানি। আমরা গণনা করিয়া জানিয়াছি যে, আজি যে ব্যক্তি এই দীঘ শহলে আরোহণ করিয়া প্রাণত্যাগ করবে। সে পানজন্মে চক্রবত্তীর্ণ রাজা হইয়া সদ্বীপা সসাগরা পথিবীর অধীশ্বর হইবে, আর যে এই ছোট শলে মরিবে, সে তাহার মন্ত্রী হইয়া জন্মিবে। মহারাজ ! তাই আমি দীঘ শহলে চড়িতে যাইতেছিলাম, এই হতভাগা আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিতেছে, আপনি বড় শহলে মরিয়া সম্রাট হইতে চায়।” তখন দ্বিতীয় চোর যোড় হাত করিয়া বলিল, “মহারাজ ! ও কে, যে, ও চক্রবত্তীর্ণ রাজা হইবে ? আমি কেন না হইব ? আজ্ঞা হউক, ও ছোট শালে চডক, আমি সম্রাট হইব, ও আমার মন্ত্রী হইবে।” তখন রাজা ভবচন্দ্ৰ ক্ৰোধে কাঁচিপত্যকলেবর হইয়া বলিলেন, “কি, এত বড় পদ্ধা! তোরা চোর হইয়া জন্মান্তরে চক্রবত্তীর্ণ রাজা হইতে চাহিস্য! সসাগরা পথিবীর অধীশ্বর হইবার উপষিক্ত পােত্র যদি কেহ থাকে, তবে সে আমি। আমি থাকিতে তোরা!!” এই বলিয়া রাজা ভবচন্দ্র তখন দ্বারিগণকে আজ্ঞা দিলেন যে, এই পাপাত্মাদিগকে তাড়াইয়া বাহির করিয়া দাও ; এবং মন্ত্রিবারকে আহবানপািৰবাক সদ্বীপা সসাগরা পথিবীর সাম্রাজ্যের লোভে স্বয়ং উচ্চ শহলে আরোহণ করিলেন। মন্ত্রী মহাশয়ও আগামী জন্মে তােদশ চক্রবত্তী রাজার মন্ত্রী হইবার লোভে ছোট শিলে গিয়া চড়িলেন। এইরপে তাঁহাদের মানবলীলা সমাপ্ত হইল। এ ইতিহাস নহে-এ সত্যও নহে-এ পিতামহীর উপন্যাস মাত্র। তবে এ ঐতিহাসিক প্রবন্ধে এই অমলক গালগলপকে স্থান দিলাম কেন ? এই কথাগালি রাজার ইতিহাস নহে, লোকের ইতিহাস বটে। ইহাতে দেখা যায়, সে রাজপরিষদিগের সম্পবন্ধে এতদর নির্বাবদ্ধিতার পরিচায়ক গলপ বাঙ্গালীর মধ্যে প্রচার লাভ করিয়াছে। ভবচন্দ্র রাজা ও গবচন্দ্ৰ পাত্রের দ্বারাও বাঙ্গালার রাজ্য চলিতে পারে, ইহা বাঙ্গালীর বিশ্বাস। যে দেশে এই সকল প্রবাদ চলিত, সে ses