পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/১৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কপালকুন্ডলা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ঃ উপকলে “Ingratitude ! Thou marble-hearted fiend!- King Lear আরোহীদিগের সফ ব্যঞ্জক কথা সমাপত হইলে, নাবিকেরা প্রস্তাব করিল যে, জোয়ারের বিলম্ব আছে;—এই অবকাশে আরোহিগণ সম্পমখস্থ সৈকতে পাকাদি সমাপন করন, পরে জলোচ্ছ বাস ৩।ার েস্বদেশাভিমখে যাত্রা করিতে পারিবেন। আরোহিবগও এই পরামশে সম্মতি দিলেন। তখন নাবিকেরা তাঁর তীরলপন করিলে আরোহিগণ অবতরণ করিয়া সনানাদি প্রাতঃকৃত্য সম্পপাদনে প্রবত্ত হইলেন। সনানাদির পর পাকের উদ্যোগে আর এক নতন বিপত্তি উপস্থিত হইল—নৌকায় পাকের কাঠ নাই। ব্যাঘভয়ে উপর হইতে কাঠ সংগ্ৰহ করিয়া আনিতে কেহই স্বীকৃত হইল না। পরিশেষে সকলের উপবাসের উপক্ৰম দেখিয়া প্রাচীন, প্রাগ্যক্ত যাবাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বাপা নবকুমার! তুমি ইহার উপায় না করিলে আমরা এতগলি লোক মারা যাই।” নবকুমার কিঞ্চিৎ কাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “আচ্ছা যাইব; কুড়ালি দাও, আর দা লইয়া একজন আমার সঙ্গে আইস।” কেহই নবকুমারের সহিত যাইতে চাহিল না। “খাবার সময় বঝা যাবে।” এই বলিয়া নবকুমার কোমর বাঁধিয়া একাকী কুঠার হস্তে কাঠাহরণে চলিলেন। তীরোপরি আরোহণ করিয়া নবকুমার দেখিলেন যে, যত দীর দণ্ডিণ্ট চলে, তত দীর মধ্যে কোথাও বসতির লক্ষণ কিছই নাই। কেবল বন মাত্র। কিন্তু সে বন, দীঘ বাক্ষাবলীশোভিত। বা নিবিড় বন নহে;--কেবল স্থানে সথানে ক্ষদ্র ক্ষদ্র উদ্ভিদ মন্ডলাকারে কোন কোন ভূমিখণড ব্যাপিয়াছে। নবকুমার তন্মধ্যে আহরণযোগ্য কাঠ দেখিতে পাইলেন না; সতরাং উপযন্ত বক্ষের অনসন্ধানে নদীতটি হইতে অধিক দীর গমন করিতে হইল। পরিশেষে ছেদনযোগ্য একটি বক্ষ পাইয়া তাহা হইতে প্রয়োজনীয় কাঠ সমাহরণ করিলেন। কাঠ বহন করিয়া আনা আর এক বিষম কঠিন ব্যাপার বোধ হইল। নবকুমার দরিদ্রের সন্তান ছিলেন না, এ সকল কম্মেম অভ্যাস ছিল না; সম্যক বিবেচনা না করিয়া কাঠ আহরণে আসিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে কাঠভার বহন বড় ক্লেশকর হইল। যাহাই হউক, যে কৰ্ম্মেম প্রবত্ত হইয়াছেন, তাহাতে অলৌপ ক্ষান্ত হওয়া নবকুমারের সর্বভাব ছিল না, এজন্য তিনি কোন মতে কাম্পঠভার বহিয়া আনিতে লাগিলেন। কিয়দার বহেন, পরে ক্ষণেক বসিয়া বিশ্রাম করেন, আবার বহেন ; এইরপে আসিতে লাগিলেন। এই হেতুবশতঃ নবকুমারের প্রত্যাগমনে বিলম্ব হইতে লাগিল। এদিকে সমভিব্যাহারিগণ তাঁহার বিলম্ব দেখিয়া উদিবগন হইতে লাগিল; তাহাদিগের এইরােপ আশঙকা হইল যে, নবকুমারকে ব্যান্ত্রে হত্যা করিয়াছে। সম্ভাব্য কাল অতীত হইলে এইরােপই তাহাদিগের হৃদয়ে সিথর সিদ্ধান্ত হইল। অথচ কাহারও এমন সাহস হইল না যে, তীরে উঠিয়া কিয়ন্দর অগ্রসর হইয়া তাঁহার অন্যসন্ধান করে। নৌকারোহিগণ এইরােপ কলপনা করিতেছিল, ইত্যবসরে জলরাশিমধ্যে ভৈরব কল্লোল উত্থিত হইল। নাবিকেরা বঝিল যে, জোয়ার আসিতেছে। নাবিকেরা বিশেষ জানিত যে, এ সকল সথানে জলোচ্ছবাসকালে তটদেশে এরােপ প্রচন্ড তরঙ্গাভিঘাত হয় যে, তখন নৌকাদি তীরবত্তীর্ণ থাকিলে তাহা খন্ডখন্ড হইয়া যায়। এজন্য তাহারা অতিব্যস্তে নৌকার বন্ধন মোচন করিয়া নদী-মধ্যবিত্তীর্ণ হইতে লাগিল। নৌকা মন্ত হইতে না হইতে সম্পমখস্থ সৈকতভূমি জলপালাবিত হইয়া গেল, যাত্ৰিগণ কেবল ত্ৰস্তে নৌকায় উঠিতে অবকাশ পাইয়াছিল, তন্ডুলাদি যাহা যাহা চরে স্থিত হইয়াছিল, তৎসমদায় ভাসিয়া গেল। দভাগ্যবশতঃ নাবিকেরা সনিপণ নহে; নৌকা সামলাইতে পারিল না; প্রবল জলপ্রবাহবেগে তরণী রসালপার নদীর মধ্যে লইয়া চলিল । একজন আরোহী কহিল, “নবকুমার রহিল যে ?” একজন নাবিক কহিল, “আঃ, তোর নবকুমার কি আছে ? তাকে শিয়ালে খাইয়াছে ?” Y SVN