পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৩৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিষবক্ষ আরও বিসময় জন্মিল। তিনি ভূতলে মচ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিলেন, তবে তাঁহার শিরোদেশে উপাধান কোথা হইতে আসিল ? আবার এক সন্দেহ-এ কি বালিশ ? বালিশ সপশ করিয়া দেখিলেন-এ ত বালিশ নহে। কোন মনতুষ্যের উরদেশ। কোমলতায় বোধ হইল, সত্ৰীলোকের উরদেশ। কে আসিয়া মচ্ছিত অবস্থায় তাঁহার মাথা তুলিয়া উরাতে রাখিয়াছে ? এ কি কুন্দনন্দিনী ? সন্দেহ ভঞ্জনার্থে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে তুমি ?” তখন শিরোরক্ষাকারিণী কোন উত্তর দিল না—কেবল দই তিন বিন্দ, উষ্ণ বারি নগেন্দ্রের কপোলদেশে পড়িল। নগেন্দ্র বঝিলেন, যেই হউক, সে কাঁদিতেছে। উত্তর না পাইয়া নগেন্দ্র তাহার অঙ্গসপশ করিলেন। তখন অকস্মাৎ নগেন্দ্ৰ বন্ধিভ্রন্ট হইলেন, তাঁহার শরীর রোমাঞ্চিত হইল। তিনি নিশে চম্পট জড়ের মত ক্ষণকাল পড়িয়া রহিলেন। পরে ধীরে ধীরে রন্ধনিশবাসে রমণীর উরদেশ হইতে মাথা তুলিয়া বসিলেন। এখন ঝড় বন্ডিট থামিয়া গিয়াছিল। আকাশে আর মেঘ ছিল না—পািকব দিকে প্রভাতোদয় হইতেছিল। বাহিরে বিলক্ষণ আলোক প্রকাশ পাইয়াছিল-গহমধ্যেও আলোকরান্ধ দিয়া অলপ অলপ আলোক আসিতেছিল। নগেন্দ্ৰ উঠিয়া বসিয়া দেখিলেন যে, রমণী গাত্ৰোথান করিল— ধীরে ধীরে দাবারোদেশে চলিল। নগেন্দ্র তখন অনভব করিলেন, এ ত কুন্দনন্দিনী নহে। তখন এমন আলো নাই যে, মানষে চিনিতে পারা যায়। কিন্তু আকার ও ভঙ্গী কতক কতক উপলব্ধ হইল। আকার ও ভঙ্গী নগেন্দ্ৰ মহত্তকাল বিলক্ষণ করিয়া দেখিলেন। দেখিয়া, সেই দণ্ডডায়মানা সত্ৰীমত্তির পদতলে পতিত হইলেন। কাতরস্বরে অশ্রীপরিপািণ লোচনে বলিলেন, “দেবীই হও, আর মানষেই হও, তোমার পায়ে পড়িতেছি, আমার সঙ্গে একবার কথা কও ৷ নচেৎ আমি মরিব।” Y রমণী কি বলিল, কপালদোষে নগেন্দ্র তাহা বঝিতে পারিলেন না। কিন্তু কথার শব্দ যেমন নগেন্দ্রের কণে প্রবেশ করিল, অমনি তিনি তীরবৎ দাঁড়াইয়া উঠিলেন। এবং দন্ডায়মান সত্ৰীলোককে বক্ষে ধারণ করিতে গেলেন। কিন্তু তখন মন, শরীর দাই মোহে আচ্ছন্ন হইয়াছে— পােনকবার বক্ষচু্যত বল্লীবৎ সেই মোহিনীর পদপ্রান্তে পড়িয়া গেলেন। আর কথা কহিলেন না। রমণী আবার উরদেশে মস্তক তুলিয়া লইয়া বসিয়া রহিলেন । যখন নগেন্দ্ৰ মোহ বা নিদ্রা হইতে উত্থিত হইলেন, তখন দিনোদয় হইয়াছে। গহমধ্যে আলো। গহপাশে বা উদ্যানমধ্যে বক্ষে বক্ষে পক্ষিগণ কলরব করিতেছে। শিরঃস্থ আলোকপন্থা হইতে বালসায্যের কিরণ গহমধ্যে পতিত হইতেছে। তখনও নগেন্দ্ৰ দেখিলেন, কাহার উরদেশে তাঁহার মস্তক রহিয়াছে। চক্ষ না চাহিয়া বলিলেন, “কুন্দ, তুমি কখন আসিলে ? আমি আজ সমস্ত রাত্ৰি সৰ্য্যেমখনীকে স্বপন দেখিয়াছি। সবপেন দেখিতেছিলাম, সােয্যমখীর কোলে মাথা দিয়া আছি। তুমি যদি সৰ্য্যমখী হইতে পারিতে, তবে কি সখি হইত!’ রমণী বলিল,- “সেই পোড়ারমখনীকে দেখিলে যদি তুমি অত সখী হও, তবে আমি সেই পোড়ারমখীই হইলাম।” - নগেন্দ্র চাহিয়া দেখিলেন। চুমকিয়া উঠিয়া বসিলেন । চক্ষম ছিলেন। আবার চাহিলেন । মাথা ধরিয়া বসিয়া রহিলেন। আবার চক্ষ মাছিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তখন পানশাচ মািখাবনত করিয়া, মদ, মদ, আপনা। আপনি বলিতে লাগিলেন, “আমি কি পাগল হইলাম-না, সৰ্য্যেমখী বাঁচিয়া আছেন ? শেষে এই কি কপালে ছিল ? আমি পাগল হইলাম!” এই বলিয়া নগেন্দ্ৰ ধরাশায়ী হইয়া বাহ মধ্যে চক্ষ লাকাইয়া আবার কাঁদিতে লাগিলেন। এবার রমণী তাঁহার পদযািগল ধরিলেন। তাঁহার পদযািগলে মােখাবােত করিয়া, তাহা অশ্রািজলে অভিষিক্ত করিলেন। বলিলেন, "উঠ উঠ ! আমার জীবনসকবসব! মাটি ছাড়িয়া উঠিয়া বসে। আমি যে এত দঃখ সহিয়াছি, আজ আমার সকল দঃখের শেষ হইল। উঠ উঠ ! আমি মারি নাই। আবার তোমার পদসেবা করিতে আসিয়াছি।” আর কি ভ্ৰম থাকে ? তখন নগেন্দ্ৰ সৰ্য্যেমখীকে গাঢ় আলিঙ্গন করিলেন। এবং তাঁহার বক্ষে মস্তক রাখিয়া, বিনা বাক্যে অবিশ্রান্ত রোদন করিতে লাগিলেন। তখন উভয়ে উভয়ের সকন্ধে মস্তক ন্যস্ত করিয়া কত রোদন করিলেন। কেহ কোন কথা বললেন না—কত রোদন করিলেন। রোদনে কি সখি! Ꮼ ᏬᏩ.