পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃতীয় খণড পণ্যের পপশা প্রথম পরিচ্ছেদ ঃ রমানন্দ স্বামী মঙেগরের এক মঠে, একজন পরমহংস বসতি কারতৌছলেন। তাঁহার নাম রমানন্দ স্বামী। সেই ব্ৰহ্মচারী তাঁহার সঙ্গে বিনীত ভাবে কথোপকথন করিতেছিলেন। অনেকে জানিতেন, রমানন্দ স্বামী সিদ্ধাপরাষ। তিনি অদ্বিতীয় জ্ঞানী বটে। প্রবাদ ছিল যে, ভারতবর্ষের লপিত দশন বিজ্ঞান সকল তিনিই জানিতেন। তিনি বলিতেছিলেন, “শন, বৎস চন্দ্রশেখর ! যে সকল বিদ্যা উপাজন করিলে, সাবধানে প্রয়োগ করিও। আর কদাপি সন্তাপকে হৃদয়ে সস্থান দিও না। কেন না, দঃখ বলিয়া একটা স্বতন্ত্র পদাৰ্থ নাই। সখি দঃখ, তুল্য বা বিজ্ঞের কাছে একই। যদি প্রভেদ কর, তবে যাহারা পণ্যাত্মা বা সখী বলিয়া খ্যাত, তাহদের চিরদঃখী বলিতে হয়।” এই বলিয়া রমানন্দ স্বামী প্রথমে, যযাতি, হরিশচন্দ্র, দশরথ প্রভৃতি প্রাচীন রাজগণের কিঞ্চিৎ প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন। শ্ৰীরামচন্দ্র, যধিস্ঠির, নলরাজা প্রভৃতির কিঞ্চিৎ উল্লেখ করিলেন। দেখাইলেন, সাব্বভৌম মহাপণ্যাত্মা রাজগণ চিরদঃখী—কদাচিৎ সখী। পরে, বশিষ্ঠ, বিশ্ববামিত্র প্রভৃতির কিঞ্চিৎ উল্লেখ করিলেন-দেখাইলেন তাঁহারাও দঃখী। দানবপীড়িত, অভিশপত ইন্দ্রাদি দেবতার উল্লেখ করিলেন-দেখাইলেন, সরলোকও দঃখপণ । শেষে, মনোমোহিনী বাকশক্তির দৈবাবতারণা করিয়া, অনন্ত, অপরিজ্ঞেয়, বিধাতৃহৃদয়মধ্যে অন্যসন্ধান করিতে লাগিলেন। দেখাইলেন যে, যিনি সব্বজ্ঞ, তিনি এই দঃখময় অনন্ত সংসারের অনন্ত দঃখরাশি অনাদি অনন্ত কালবাঁধ হৃদয়মধ্যে অবশ্য অনভূত করেন। যিনি দয়াময়, তিনি কি সেই দঃখরাশি অনভূত করিয়া দঃখিত হন না ? তবে দয়াময় কিসে? দঃখের সঙ্গে দয়ার নিত্য সম্মবন্ধ-দঃখ না হইলে দয়ার সঞ্চার কোথায় ? যিনি দয়াময়, তিনি অনন্ত সংসারের অনন্ত দঃখে অনন্ত কাল দঃখী—নচেৎ তিনি দয়াময় নহেন। যদি বল, তিনি নিবিবর্তকার, তাঁহার দঃখ কি ? উত্তর এই যে, যিনি নিবিবর্তকার, তিনি সন্টিস্থিতিসংহারে সপহাশন্য—তাঁহাকে সম্পটা বিধাতা বলিয়া মানি না। যদি কেহ সম্পটা বিধাতা থাকেন, তবে তাঁহাকে নিবিবর্তকার বলিতে পারি না-তিনি দঃখময়। কিন্তু তাহাও হইতে পারে না; কেন না, তিনি নিত্যানন্দ । অতএব দঃখ বলিয়া কিছ নাই, ইহাই সিদ্ধ। রমানন্দ স্বামী বলিতে লাগিলেন, “আর যদি দঃখের অস্তিত্বই স্বীকার কর, তবে এই সব্বব্যাপী দঃখ নিবারণের উপায় কি নাই ? উপায় নাই; তবে যদি সকলে সকলের দঃখ নিবারণের জন্য নিযক্ত থাকে, তবে অবশ্য নিবারণ হইতে পারে। দেখ, বিধাতা স্বয়ং অহরহ সন্টির দঃখ নিবারণে নিযন্ত। সংসারের সেই দঃখনিবত্তিতে ঐশিক দঃখেরও নিবারণ হয়। দেবগণ জীবদ্যুঃখ-নিবারণে নিযক্ত-তাহাতেই দৈব সখি। নচেৎ ইন্দ্রিয়াদির বিকারশান্য দেবতার অন্য সখি নাই।” পরে ঋষিগণের লোকহিতৈষিতা, কীত্তন করিয়া ভীস্মাদি বীরগণের পরোপকারিতার বর্ণনা করিলেন। দেখাইলেন, যেই পরোপকারী, সেই সখী, অন্য কেহ সখী নহে। তখন রমানন্দ স্বামী শতমখে পরোপকার ধর্মের গণকীৰ্ত্তন আরম্ভ করিলেন। ধৰ্ম্মশাস্ত্র, বেদ, পরাণেতিহাস প্রভৃতি মন্থন করিয়া অনগািল ভুরি ভুরি প্রমাণ প্রযক্ত করিতে লাগিলেন। শব্দসাগর মন্থন করিয়া শত শত মহাৰ্থ শ্রবণমনোহর, বাক্যপরম্পরা কুসমমােলাবৎ গ্রন্থন করিতে লাগিলেন—সাহিত্য-ভান্ডার লন্ঠন করিয়া, সারবতী, রসপণা, সন্দলওকারবিশিস্টা কবিতানিচয় বিকীর্ণ করিতে লাগিলেন। সব্বোপরি, আপনার আকৃত্ৰিম ধৰ্ম্মমােনরোগের মোহময়ী প্রতিভান্বিতা ছায়া বিস্তারিত করিলেন। তাঁহার সকণঠনিগত, উচ্চারণকৌশল্যযন্ত সেই অপািকব বাক্যসকল চন্দ্ৰশেখরের কণে তােয্যনাদবাং ধবনিত হইতে লাগিল। সে বাক্যসকল কখন মেঘগজজািনবৎ গম্ভীর শব্দে শবিদ্যুত হইতে লাগিল—কখন বীণানিক্কণবৎ মধর বোধ হইতে লাগিল। ব্ৰহ্মচারী বিস্মিত, মোহিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার শরীর কণাটকিত হইয়া উঠিল। 8 RN