পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৬০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণকান্তের উইল পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ ভ্রমর মরিয়া গেল। যথারীতি তাহার সৎকার হইল। সৎকার করিয়া আসিয়া গোবিন্দলাল গহে বসিলেন। গহে প্রত্যাবৰ্ত্তন করিয়া অবধি, তিনি কাহারও সহিত কথা কহেন নাই। আবার রজনী পোহাইল। ভ্রমরের মতুর পরদিন, যেমন সায্য প্রত্যহ উঠিয়া থাকে, তেমনি উঠিল। গাছের পাতা ছায়ালোকে উক্তজবল হইল—সরোবরের কৃষ্ণবারি ক্ষদ্র বীচি বিক্ষেপ কুরিয়া ফুলিতে লাগিল; আকাশের কালাে মেঘ শাদা হইল-ভ্রমর যেন মরে নাই। গােবিন্দলাল হইলেন। গোবিন্দলাল দাই জন সত্ৰীলোককে ভাল বাসিয়াছিলেন—-ভ্রমরকে আর রোহিণীকে। রোহিণী মরিল—ভ্রমর মরিল। রোহিণীর রাপে আকৃষ্ণটি হইয়াছিলেন— যৌবনের অতৃপিত রািপতৃষ্ণা শান্ত করিতে পারেন নাই। ভ্রমরকে ত্যাগ করিয়া রোহিণীকে গ্রহণ করিলেন। রোহিণীকে গ্রহণ করিয়াই জানিয়াছিলেন যে, রোহিণী, ভ্রমর নহে—এ রােপতৃষ্ণা, এ স্নেহ নহে—এ ভোগ, এ সখি নহে—এ মন্দারঘাষণাপীড়িত বাসকিনিশবাসনিগত হলাহল, এ ধন্বন্তরিভান্ডনিঃসতে সন্ধা নহে। বঝিতে পারিলেন যে, এ হৃদয়সাগর, মন্থনের উপর মন্থন করিয়া যে হলাহল তুলিয়াছি, তাহা অপরিহায্য, অবশ্য পান করিতে হইবে—-নীলকণ্ঠের ন্যায় গোবিন্দলাল সে বিষ পান করিলেন। নীলকণ্ঠের কন্ঠস্থ বিষের মত, সে বিষ তাঁহার কণ্ঠে লাগিয়া রহিল। সে বিষ জীৰ্ণ হইবার নহে!—সে বিষ উদগীর্ণ করিবার নহে। কিন্তু তখন সেই পািব্ব পরিজ্ঞাতস্বাদ বিশদ্ধ ভ্ৰমরপ্রণয়সাধা—সবগীয় গন্ধযক্তি, চিত্তপল্টিকর, সকবরোগেব ঔষধস্বরপ, দিবারাত্ৰি সমতিপথে জাগিতে লাগিল। যখন প্রসাদপরে গোবিন্দলাল রোহিণীর সঙ্গীতস্রোতে ভাসমান, তখনই ভ্রমর তাঁহার চিত্তে প্রবলপ্রতাপযক্তা অধীশবরী-ভ্রমর অন্তরে, রোহিণী বাহিরে। তখন ভ্ৰমর অপ্রাপণীয়া, রোহিণী অত্যাজ্য,-তব্য ভ্রমর অন্তরে, রোহিণী বাহিরে। তাই রোহিণী অতি শীঘ্ৰ মরিল। যদি কেহ সে কথা না বঝিয়া থাকেন, তবে ব্যথায় এ আখ্যায়িকা লিখিলাম। যদি তখন গোবিন্দলাল, রোহিণীর যথাবিহিত ব্যবস্থা করিয়া স্নেহময়ী ভ্ৰমরের কাছে যক্ত করে আসিয়া দাঁড়াইত, বলিত, “আমায় ক্ষমা কর—আমায় আবার হৃদয়প্রান্তে স্থান দাও।” যদি বলিত, “আমার এমন গণ নাই, যাহাতে আমায় তুমি ক্ষমা করিতে পাের, কিন্তু তোমার ত অনেক গণ আছে, তুমি নিজগণে আমায় ক্ষমা কর,” বঝি তাহা হইলে, ভ্রমর তাহাকে ক্ষমা করিত। কেন না, রমণী ক্ষমাময়ী, দয়াময়ী, স্নেহময়ী;—রমণী ঈশবিরের কীৰ্ত্তির চরমোৎকষ, দেবতার ছায়া; পরষ দেবতার সন্টিমাত্র। সত্ৰী আলোক ; পরষ ছায়া। আলো কি ছায়া ত্যাগ করতে পারিত ? গোবিন্দলাল তাহা পারিল না। কতকটা অহঙ্কার-পরিষ, অহঙ্কারে পরিপািণ—কতকটা লডজা—দােন্ডকৃতকারীর লডজাই দন্ড। কতকটা ভয়—পাপ, সহজে পণ্যের সম্পমখীন হইতে পারে। না। ভ্রমরের কাছে আর মািখ দেখাইবার পথ নাই। গোবিন্দলাল আর অগ্রসর হইতে পারিল না। তাহার পর গোবিন্দলাল হত্যাকারী। তখন গোবিন্দলালের আশা ভরসা ফরাইল। অন্ধকার আলোকের সম্পমখীন হইল না। কিন্তু তব, সেই পনঃপ্রজবলিত, দািববার, দাহকারী ভ্রমরদর্শনের লালসা বর্ষে বর্ষে, মাসে মাসে, দিনে দিনে, দন্ডে দন্ডে, পালে পলে, গোবিন্দলালকে দাহ করিতে লাগিল। কে এমন পাইয়াছিল ? কে এমন হারাইয়াছে ? ভ্ৰমরও দঃখ পাইয়াছিল, গোবিন্দলালও দঃখ পাইয়াছিল। কিন্তু গোবিন্দলালের তুলনায় ভ্রমর সখী । গোবিন্দলালের দঃখ মনষ্যদেহে অসহ্য — ভ্রমরের সহায় ছিল—যম সহায় । গোবিন্দলালের সে সহায়ও নাই। আবার রজনী পোহাইল—আবার সােয্যালোকে জগৎ হাসিল। গোবিন্দলাল গহ হইতে নিম্পর্কান্ত হইলেন।—রোহিণীকে গোবিন্দলাল স্বহস্তে বধ করিয়াছেন—ভ্রমরকেও প্রায় সর্বহস্তে বধ করিয়াছেন। তাই ভাবিতে ভাবিতে বাহির হইলেন। আমরা জানি যে, সে রাত্ৰি গোবিন্দলাল কি প্রকারে কাটাইয়াছিলেন। বোধ হয়। রাত্রি বড় ভয়ানকই গিয়াছিল। দবার খালিয়াই মাধবীনাথের সঙ্গে তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। মাধবীনাথ তাঁহাকে দেখিয়া, মািখপানে চাহিয়া রহিলেন-—মখে মনষ্যের সাধ্যাতীত রোগের ছায়া। VO V)