میستایج বঙ্গদর্শন । [ ৩য় বর্ষ, অশ্বিন। . এইরূপে প্রকৃতি হইতে মনে ও মন হইতে সাহিত্যে যাহা প্রতিফলিত হইয়া উঠে, তাহা অনুকরণ হইতে বহুদূরবত্তী । প্রকৃত সাহিত্যে আমরা আমাদের কল্পনাকে, আমাদের সুখদুঃখকে, শুদ্ধ বর্তমান কণল নহে, চিরন্তন কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহি । সুতরাং সেই সুবিশাল প্রতিষ্ঠাক্ষেত্রের সহিত তাহার পরিমাণসামঞ্জস্ত করিতে হয় ! ক্ষণকালের মধ্য হইতে উপকরণ ংগ্ৰহ করিয়া তাহাকে যখন চিরকালের জন্ত গড়িয়া তোলা যায়, তখন ক্ষণকালের মাপকাঠি লইয়া কাজ চলে না। এই কারণে প্রচলিত কালের সহিত, সঙ্কীর্ণ সংসারের সহিত, উচ্চসাহিত্যের পরিমাণের প্রভেদ তথাকিয়া যায় । অস্তরের জিনিষকে বাহিরের, ভাবের জিনিষকে ভাষার, নিজের জিনিষকে বিশ্বমানবের এবং ক্ষণকালের জিনিষকে চিরকালের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ । জগতের সহিত মনের যে সম্বন্ধ, মনের সহিত সাহিত্যকারের প্রতিভার সেই সম্বন্ধ । এই 'প্রতিভাকে বিশ্বমানবমন নাম দিলে ক্ষতি নাই । জগৎ হইতে মন আপনার জিনিষ সংগ্ৰহ করিতেছে, সেই মন হইতে . বিশ্বমানবমন পুনশ্চ নিজের জিনিস নিৰ্ব্বাচন করিয়া নিজের জন্ত গড়িয়া লইতেছে। বুঝিতেছি কথাটা বেশ ঝাপসা হইয়া - আসিয়াছে। অার একটু পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করিব । কৃতকাৰ্য্য হইব কি না, জানি না । আমরা আমাদের অন্তরের মধ্যে হুইট ংশের অস্তিত্ব অমুভব করিতে পারি। একটা অংশ আমার নিজত্ব, আর একটা অংশ আমার মানবত্ব । আমার ঘরটা যদি সচেতন হইত, তবে সে নিজের ভিতরকার খণ্ডাকাশ ও তাহারই সহিত পরিব্যাপ্ত মহাকাশ, এই দুটাকে ধ্যানের দ্বারা উপলব্ধি করিতে পারিত । আমাদের ভিতরকার নিজত্ব ও মানবত্ব সেইপ্রকার । যদি দুয়ের মধ্যে দুর্ভেদ্য দেয়াল তোলা থাকে, তবে আত্মা অন্ধকূপের মধ্যে বাস করে । প্রকৃত সাহিত্যধকারের অন্তঃকরণে যদি তাহার নিজত্ব ও মানবত্বের মধ্যে কোন ব্যবধান থাকে, তবে তাহ কল্পনার কাচের সাশির স্বচ্ছ ব্যবধান । তাহার মধ্য দিয়া পরস্পরের চেনা-পরিচয়ের ব্যাঘাত ঘটে না । এমন কি, এই কাচ দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণের কাচের কাজ করিয়া থাকে --ইহা অদৃশ্বকে দৃশু, দুরকে নিকট করে । - সাহিত্যকারের সেই মানবত্বই স্বজনকৰ্ত্ত । লেখকের নিজত্বকে সে আপনার করিয়া লয়, ক্ষণিককে সে অমর করিয়া তোলে, খণ্ডকে সে সম্পূর্ণতা দান করে । জগতের উপরে মনের কারখানা বসিয়াছে—এবং মনের উপরে বিশ্বমনের কণরথানা—সেই উপরের তলা হইতে সাহিতে উৎপত্তি । * পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, মনোরাজ্যের কথা আসিয়া পড়িলে সত্যতা বিচার করা কঠিন হইয়া পড়ে । কালোকে কালো প্রমাণ করা সহজ, কারণ অধিকাংশের কাছেই তাই নিশ্চয় কালো—কিন্তু ভালোকে ভালেী প্রমাণ করা তেমন সহজ নহে, কারণ এখানে অধিকাংশের একমত সাক্ষ্য সংগ্রহ করা কঠিন।
পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় তৃতীয় খণ্ড.djvu/২৯১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।