২৩৪ উচ্চতম সামাজিক আদর্শের একটা অপূৰ্ব্ব সঙ্গতিসাধন করিতে চাহিয়াছিলেন । গ্রাহ্ম সমাজের পরবর্তী আচাৰ্য্যগণের ন্যায়, রামমোহন কি তত্ত্ববিচারে কি ধৰ্ম্মসাধনে একান্তভাবে শাস্ত্রগুরুর অধিকার ও প্রামাণ্য অগ্রাহ্য করেন নাই। কিয়ৎ-পরিমাণে মাটিন লুথারের মত রাজা রামমোহনও শাস্ত্রনিদ্ধারণে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন বটে,কিন্তু পরবর্তী ব্রাহ্ম আচাৰ্য্যগণের দ্যায় শাস্ত্রের প্রামাণ্য ও অধিকার একেবারে অস্বীকার করেন নাই । ত’বার অন্যদিকে লুথারের ন্যায় রাজা শাস্ত্রার্থনিৰ্দ্ধারণে সদগুরুর প্রয়োজন অগ্রাহা করিয়া, কেবলমাত্র স্বানুভূতির উপরেই শাস্ত্রোপদেশের সত্যাসত্য নির্ণয়ের ভারও অর্পণ করেন নাই । এইজন্তই প্রোটেষ্টাণ্ট খৃষ্টীয় সিদ্ধান্তে *STRSFSI—Scripture & Private Judgmentএর মধ্যে যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা হয় নাই, রাজা আপনার সিদ্ধাস্তে, শাস্ত্রার্থ বিচারে, সদগুরুর যথাযোগ্য স্থান ও অধিকার প্রদান করিয়া, অতি সহজেই সেই সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছেন। আর এইরূপেই রাজা রামমোহন তত্ত্ববিচারে ও ধৰ্ম্মসাধনে ভারতের প্রাচীন এবং যুরোপের আধুনিক সাধনার উচ্চতম আদর্শের মধ্যে একটা অতি সুন্দর সঙ্গতি স্থাপন করিয়াছিলেন । রাজার সামাজিক সিদ্ধ যেমন তত্ত্ববিচারে ও ধৰ্ম্মসংস্কারে, সেইরূপ আপনার সামাজিক সিদ্ধান্তেও রাজ রামমোঙ্গন প্রাচীন ভারতেরও আধুনিক যুরোপের সাধনার মধ্যে একটা অতি সুন্দর সঙ্গতি স্থাপন বঙ্গদর্শন [ ১২শ বর্ষ, শ্রাবণ, ১৩১৯ করিয়াই আমাদিগের বর্তমান যুগ-আদর্শকে সামাজিক জীবন সম্বন্ধেও একই সঙ্গে স্বাদেশিক ও সাৰ্ব্বজনীন করিয়া তুলিবার চেষ্ট করেন। সমাজ-জীবনের শৈশবে জগতের সৰ্ব্বত্রই সমাজের কৰ্ম্ম বিভাগ বংশ-মর্যাদার অনুসরণ করিয়া চলে। যে যে বংশে জন্ম গ্রহণ করে, সেই বংশের পুরুষানুক্রমিক কৰ্ম্ম ও অধিকারই সমাজ-জীবনে তার নিজেরও কৰ্ম্ম ও অধিকার হয়। যখন পিতা বা পিতৃব্য বা তাহাঁদের অভাবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই প্রত্যেক শিশুর একমাত্র দীক্ষাগুরুও শিক্ষাগুরু ছিলেন, পরিবারের বাহিরে যখন বাল্যশিক্ষার কোনো বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তখন কোনো ব্যক্তির পক্ষে পৈত্রিক ব্যবসায় পরিত্যাগ করিয়া, ব্যবসায়ান্তর গ্রহণে জীবিকা উপার্জন করা একান্ত অসাধ্য না হইলেও, নিত্যস্তই দুঃসাধ্য ছিল, সন্দেহ নাই। সে অবস্থায় ব্যক্তিবিশেষের কুলধৰ্ম্মই সমাজ-দেন্তে তাহার বিশেষ স্থান ও কৰ্ম্ম নিৰ্দ্ধারণ করিত। আর সে সময়ে জনগণের কৰ্ম্ম ও অধিকারভেদ জন্মগত হইলেও প্রকৃত পক্ষে গুণ-কৰ্ম্মবিভাগের উপরেই প্রতিষ্ঠিতও ছিল । সমাজবিজ্ঞানের এই ঐতিহাসিক তত্ত্বকে লক্ষ্য করিয়াই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন – চতুৰ্ব্বণ্যম্ ময় স্বঃম্ গুণকৰ্ম্মবিভাগশ: | এই সাধারণ সমাজতত্ত্বের উপরেই হিন্দুর বর্ণ-বিভাগ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হিন্দু’ এই স্বাভাবিক কৰ্ম্মবিভাগের সঙ্গে আশ্রম চতুষ্টয়কে যুক্ত করিয়া এই বর্ণভেদের ভিতর দিয়াই যে অভেদ শিক্ষারও ব্যবস্থা করিয়াছিলেন,জগতের আর কোনো জাতি সমাজ-জীবনের শৈশবে ও কৈশোরে সেরূপ ব্যবস্থা করিতে পারেন
পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বাদশ খণ্ড.djvu/২৩৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।