२8b যৌবনের কাহিনী শুনিয়া, হিন্দু তাহাকে একটা একান্ত উপহাস্তাস্পদ ব্যাপার বলিয়াও ভাবে না । জগন্নাথকে দারুব্রহ্মও বলে। পুরীতে যে জগন্নাথ-বিগ্রহ আছেন, তাহার উপাদান মৃত্তিকাও নয়, ধাতুও নয়, কিন্তু কাঠ । আর এই মূৰ্ত্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি গড়াও নয়, খোদাও নয় ; কেবল রং করা মাত্র। এই রং ষতই কেন পাক হউক না, প্রতিদিন তৈলচন্দনাদির দ্বারা অভিষিক্ত হইলে ক্রমে নিম্প্রভ হইয়। যাইবেই যাইবে । এই জন্য অন্ততঃ বৎসরে একবার করিয়া ইহার নূতন রং করা আবশ্বক হয়। জগস্নাথের স্নানযাত্রার পরে, রথযাত্রার পূৰ্ব্বে এই নূতন রং দেওয়া হয়। এই কারণে এই একমাস কাল জগন্নাথের মূৰ্ত্তিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা হয়। মাসান্তে, রথের দিনে, আবার নবরঞ্জিত দেবমূৰ্ত্তিকে রথারূঢ় করাইয়া, তার রথযাত্রা হইয়া থাকে। কিন্তু কাঠ তো আর চিরদিন থাকে না। সুতরাং জগন্নাথের মূৰ্ত্তির কেবল রং বদলাইলেই চলে না,মাঝে মাঝে দারুখানাও বদলাইয়া নূতন করা আবণ্ঠক হয়। এই দারুবদলান-ব্যাপারকেই জগন্নাথের নবকলেবর বা নবযৌবন বলে। পূর্ণিমা দিন জগন্নাথের স্বানযাত্রা হয়। পরবর্তী অমাবস্তা রাত্রে, জগন্নাথের পুরাতন দেহ “শ্মশানে” লইয়া গিয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। মন্দিরপ্রাঙ্গণের ভিতরেই একটা স্থান আছে, যাহাকে জগন্নাথের শ্মশান বলে । স্নানযাত্রার পরবর্তী অমাবস্য-রাত্রে "দ্বৈতপভি” নামে এক বিশেষ গোত্রের পাণ্ড, সপরিবারে ৭ঙ্গ দশম { ১২শ পর্ম, শ্রাবণ, ১৩১৯ জগন্নাথের পুরাতন দারুকে নারায়ণ-বিগ্রহ বা শালগ্রামশীলার সঙ্গে এক ছোট রথে চড়াইয়া প্রথমে মন্দির প্রদক্ষিণ করায়, পরে সেই শ্মশানে লইয়া গিয়া দারুখণ্ডকে ফেলিয়া দেয় । সে দিন সন্ধ্যা হইতে মন্দির একেবারে বন্ধ থাকে। দ্বৈতপতি পাণ্ড ও র্তার পরিবারের লোক ব্যতীত আর কেহ সে রাত্রে মন্দিরে প্রবেশ করিতে বা মন্দিরের ভিতরে থাকিতে পারে না। এইরূপে জগস্নাথের পুরাতন কলেবর শ্মশানে ফেলিয়৷ দিয়া, নারায়ণকে সেখান হইতে শ্ৰীমন্দিরে ফিরাইয়া অনিয়া যথাস্থানে রক্ষা করা হয়। এই নারায়ণই নিত্য বস্তু। ইনিই দারুব্রহ্মের আত্মাস্বরূপ। দারু কালবশে জীর্ণ হইয়। যখন পরিত্যাগযোগ্য হয়, তখন তাহাকে শ্মশানে ফেলিয়া আসা হয় ; কিন্তু তার আত্মাস্বরূপ নারায়ণের তো আর বিনাশ নাই। সুতরাং নারায়ণকে শ্মশান হইতে ফিরাইয়া আনিয়া রাখা হয়। নুতন মূৰ্ত্তি যখন আবার গঠিত হয়। তখন এই নারায়ণই তাহাতে অধিষ্ঠিত হইয়া, তাহাকে আপনার বিগ্রহ করেন। তখন আবার এই সামান্য কাঠের বস্তুই দেবতার দেহরূপে অর্চিত চর্চিত পূজিত সেবিত হইয়া থাকে। এই রূপেই জগন্নাথের “নবকলেবর” বা "নব যৌবন” হয়। ভক্তেরা এ ব্যাপারকে লীলা বলেন। তুমি আমি ইহাকে রূপক বলিতে পারি। কিন্তু হিন্দু যে আপনার দেবতার রোগে, মৃত্যুতে ও পুনজন্মে বিশ্বাস করে, তার দেবতার যে সত্য সত্যই নবযৌবন বা নবকলেবর হয় বলিয়া মনে করে, এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না ।
পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বাদশ খণ্ড.djvu/২৫৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।