৭৩৮ ভাবে উত্তর করিলেন "ঈশ্বর যাহা করাহঁতেছেন, আমি তাহাই করিতেছি । খণ্ড খণ্ড হয় দেহ, যদি যায় প্রাণ, তবু আমি বদনে না ছাড়ি হরিনাম।” বাদশাহ ক্রুদ্ধ হইয়া আদেশ করিলেন “এই দুৰ্ব্বত্তকে বাইশ বাজারে বেত্ৰাঘাত করিয়া বধ কর । যদি নিদারুণ বেঞ্জাঘাতেও প্রাণান্ত না হয়, তাহা হইলে বুঝিব এ যাহা বলিয়াছে, তাহা সত্য ।” রাজাজ্ঞা প্রতিপালিত হইল। পাইকগণ হরিদাসকে ধরিয়া বাজারে বাজারে প্রকাগু ভাবে নিদারুণ প্রহার করিতে লাগিল। জনসাধারণ সাধুর অপমানে ক্ষুণ্ণ হইয়া বাদশাহ ও উজীরকে অভি. সম্পাত করিতে লাগিল। কিন্তু হরিদাস নিৰ্ব্বিকার ; তিনি তখন স্বীয় আরাধ্য দেবতার ধ্যানে বাহ্যজ্ঞানহীন, ঘাতকগণের আঘাত র্তাহার শরীরে লাগিল না । যে সকল হতভাগ্য তাহাকে প্রহার করিয়াছিল, কেবল তাহাদের জন্তই তাহার প্রাণ মাঝে মাঝে ব্যাকুল হইয়া উঠিতেছিল, এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করিয়াছিলেন, “হে কৃষ্ণ, এই দুর্ভাগ্য রাজভৃত্যদিগকে দয়া কর, আমার উপর যে দ্রোহীচরণ করিতেছে, তজ্জন্ত যেন ইহাদিগকে শাস্তিভোগ করিতে না হয়।” পাইকগণ যখন দেখিল, তাহাদের প্রহারে হরিদাসের কিছুই হইল না, তখন হরিদাসকে কহিল “হরিদাস, তোমার প্রাণ নাশ করিতে আমাদিগের উপর আদেশ হইয়াছে, কিন্তু এত প্ৰহারেও যখন তোমার প্রাণ বহির্গত হইল না তখন কাজীর হাতে আর আমাদের নিস্তার নাই।” দয়ালু হরিদাস কহিলেন “আমি জীবিত থাকিলে যদি তোমাদের অনিষ্ট বঙ্গদর্শন [ ১২শ বর্ষ, চৈত্র, ১৩১৯ হয়, তবে আমার জীবিত থাকিয়া কাজ নাই।” এই বলিয়া যোগী হরিদাস ধ্যানাবিষ্ট হইলেন। পাইকগণ র্তাহার নিশ্চেঃ দেহ লইয়া বাদশাহসমীপে উপস্থাপিত করিল। বাদশাহ সেই দেহ কবরস্থ করিবার আদেশ প্রদান করিলেন । কিন্তু দুষ্ট কাল্পীগণ প্রতিবাদী হইয়া বলিয়া উঠিল “পাপিষ্ঠ মুসলমান হইয়া হিন্দুর আচরণ অবলম্বন করিয়াছিল ; উহার দেহ কবরস্থ করা সঙ্গত নহে। নদীতে লইয়া উহাকে ফেলিয়া দে ঔ।” হরিদাস গঙ্গাবক্ষে নিক্ষিপ্ত হইলেন। ভাগীরথীর তরঙ্গচঞ্চল বক্ষে ভাসিতে ভাসিতে হরিদাসের জ্ঞান ভঙ্গ হইল। তখন তিনি সন্তরণপূৰ্ব্বক তীরে উঠিয়া বাদশাহ-দরবারে গমন করিলেন। বাদশাহ স্তম্ভিত হইলেন। সভাসদগণ নিৰ্ব্বাক হইয়। চিত্রাপিতবৎ অবস্থিতি করিতে লাগিঙ্কেন। হরিদাসের অসাধারণত্ব প্রমাণিত হইল। বাদশাহ সভাসদগণ সহ দণ্ডায়মান হইয়া'হরিদাসের স্তব করিতে, লাগিলেন এবং র্তাহার প্রসাদ ভিক্ষা করিলেন । বাদশাহ-দরবার পরিত্যাগ পূৰ্ণক হরিদাস ফুলিয়া গ্রামে গমন করিলেন । ফুলিয়ায় ব্রাহ্মণগণ তাছাকে দেখিয়া আনন্দে হরিধ্বনি করিয়া উঠিলেন। প্রেমবিহ্বল হরিদাস প্রেমানন্দে নাচিতে নাচিতে কহিলেন, ‘ভক্তগণ আমার জন্য দুঃখ করিবার প্রয়োজন নৃাই, জীবনে ঈশ্বরনিনা। অনেক গুনিয়াছি, তাই ঈশ্বর রাজদরবারে আমার শান্তি সংঘটন করিয়া দিয়াছেন। পাপের তুলনায় শাস্তি আমার সামান্তই হইয়াছে।” g গঙ্গাতীরে এক গোফা নিৰ্ম্মাণ করিয়া হরিদাস তথায় সাধন-ভজনে নিমগ্ন রহিলেন ।
পাতা:বঙ্গদর্শন নবপর্যায় দ্বাদশ খণ্ড.djvu/৭৪৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।