পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/১৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৪৫
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড

॥ ৯০॥
মো: আছির উদ্দিন মুন্সী
গ্রাম চিরিরবন্দর মাজাপাড়া
থানা-চিরিবন্দর, জেলা- দিনাজপুর

 বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে খান সেনারা চিরিবন্দরে ক্যাম্প করে। এখানে ক্যাম্প করার পর স্থানীয় গ্রামবাসীরা প্রাণের ভয়ে কতক ভারতে ও কতক গ্রাম থেকে গ্রামঞ্চলে চলে যায়। এই সময়ে আমি স্ত্রী-পুত্রদের সংগে নিয়ে দুই মাইল দূরে আমার শ্বশুরবাড়ী বালুপাড়ায় চলে যাই। আমি একদিন বালুপাড়া সন্নিকটে মরা নদীর ব্রীজের কাছে এক দিকে চিরিরবন্দর হতে অপর দিকে পার্বতীপুর হতে এই দুই দিক হতে দুটি পাক সৈন্য বোঝাই গাড়ি এসে থামে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, উক্ত ব্রীজটি এর পূর্বেই ইপিআর বাহিনী ভেংগে দেয়। উক্ত বালুপাড়া গ্রামের ২১- ২২ জন লোক ঐ গাড়ি দুটিতে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আঁছে ভেবে তাদের অভিনন্দন জানানোর জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু নিকটে যাবার সংগে সংগে চারদিকে হতে খান সেনারা তাদেরকে ঘিরে ফেলে। উক্ত ২০- ২১ জনকে পরে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় হত্যা করে এবং লাশগুলি কাঁকড়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এই ঘটনার ৩-৪ দিন পরে বালুপাড়া গ্রামটি খান সেনারা তিন দিক হতে ঘিরে ফেলে। খান সেনাদের উপস্থিত সম্পর্কে গ্রামবাসীরা পূর্বেই টের পেয়েছিল। এবং তারা আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। ফলে খান সেনারা সেদিন গ্রাম থেকে কাউকে ও ধরতে পারে না। এদিকে গ্রামবাসীরা তাদের আর উক্তগ্রামে থাকা উচিত নয় ভেবে অন্যএ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং খান সেনারা গ্রাম হতে চলে যাওয়ার পর গ্রামবাসীরা তাদের পোটলা-পুটলি আনার জন্য রাতের অন্ধকারে প্রবেশ করে। আমি উক্ত বালুপাড়া গ্রামে হতে আমার নানাশ্বশুরের বাড়ী দুর্গপুর (২ মাইল) যাওয়ার জন্য তৈরী হই। এবং শেষ রাত্রের দিকে রওনা দেই। এদিকে খান সেনারা বালুপাড়া গ্রাম ও দর্গাপুর গ্রামের মাঝখানে ঐ রাত্রের অন্ধকার মিশন স্কুল পজিশন নেয়। আমি ও আমার ভাই গরু বাছুর নিয়ে যখন মিশন স্কুলের নিকটে পৌছাই তখন হঠাৎ করে ১৮ জন খান সেনা ও ৪ জন অবাঙ্গালী রাজাকার আমাদের দুজনকে ঘিরে ফেলে এবং একজন আমাকে লক্ষ্য করে এক রাউণ্ড গুলি ছোড়ে। কিন্তু খোদা মেহেরবান গুলি আমাদের দুজনের একজনকে ও না লেগে আমাদের সংগে আনা একটি গরুর পায়ে বিদ্ধ হয়।

 পূর্ব হতেই আর ও দুজন দাড়িওয়ালা মুরুববী গোছের লোককে উক্ত স্কুলের সামনে বেঁধে রেখেছে। খান একজন আমাকে বলে যে,” ইয়ে মৌলভী সাব আপ কাঁহা যাতে হেঁ। জবাবে আমি যে গরু বাছুর নিয়ে জমিনে কাজ করতে যাচ্ছি। খান সেনারা পুনরায় বলে যে, তোম ইণ্ডিয়ামে বাগ যাতে হেঁ” জবাবে বলি যে, না ভাই আমি ইণ্ডিয়া যাচ্ছি না। আমি জমিনে কাজ করতে যাচ্ছি। খান সেনারা পুনরায় আমাকে প্রশ্ন করে যে,” ইয়ে মৌলভী সাব আপ ছাচ্ছা বাত বলেগা তো আপকো হাম ছোড় দেগা, আপ বলিয়ে আওয়ামী লীগকা পার্টি কাঁহা, স্কুল কলেজ কাঁহা, ছাত্র কাঁহা, মালাউন কাঁহ।” উত্তরে আমি বলি যে, যারা আওয়ামী লীগ, ছাত্র এবং মালাউন সাবাই ভারতে পালিয়ে গেছে। যারা এখানে আছে তারা সকলেই খাঁটি পাকিস্তানী। এই সময় খান সেনাদের সাথী অবাঙ্গালী রাজাকাররা আমাকে বাংলায় বলে যে” আপনি ভয় পাবেন না আমরা ভারতীয় সৈন্য। এখানে বিহারীরা আসবার চেষ্টা করেছে। তাদের বাধা দেওয়ার আমরা এখানে পজিশন নিয়েছি।”

 আমি সরলমনে এটা বিশ্বাস করি এবং বলি যে “ভাই আমি থাকব না আমাকে ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।” উত্তরে রাজাকাররা আমাকে আশ্বাস দেয় এবং বলে যে আপনি কোন চিন্তা করবেন না, সে ব্যবস্থ আমরা করছি