পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/২৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Հ8Հ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড আমাকে যে ঘরে বন্দী করা হয় ঐ ঘরে আরও ১৮ জন বন্দী ছিল। প্রতি দুই ঘণ্টা পর ডিউটিরত সিপাই চেঞ্জ হয়ে যেত। প্রতিবারেই আমার উপর সিপাইরা লাথি ঘুষি মারতে থাকে আর জিজ্ঞাসা করে মুক্তিবাহিনী কোথায়? এনায়েত মিয়া, ডাঃ আবদুল হাই, ডাঃ ক্ষিতিশ মণ্ডল এই সব আওয়ামী লীগের নেতারা কোথায় আছে। রাইফেল কোথায় আছে? ৩ দিন পর আমার উপর এইভাবে অত্যচার চালায়। এই সময় আর কোন নতুন আসামী তারা ঢুকায় না। তবে ঘরের বাইরে যে লোক ধরে এনে ভীষনভাবে প্রহার করে এটা আমি হাজতের ভিতর থেকে টের পাই। ১০ দিন পর বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও ১৪ জন লোককে ধরে আনে এবং তাদের সঙ্গে আমাকে এসডিও সাহেবের বাসার ভিতর একটা পায়খানার মধ্যে বন্দী করে রাখে। এদের মধ্যে আলী আশরাফ নামে একজন ছেলে। ঢাকা থেকে আসার পথে “হুলার হাট’ লঞ্চ ঘাটে পাক সেনারা তাকে আটক করে। তাকে আটক করার পর ক্যাপ্টেন একটা হোটেলের চুলার ভিতরকার আধাপোড়া কাঠ এনে তার শরীরের বিভিন্ন যায়গায় চেপে ধরে। সারা শরীরের চামড়া ও মাংস পুড়ে দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে। এবং ছেলাটার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালান হয়। হাজতে আনার পর নিয়মিতভাবে আমাদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে। আমাকে হাজির করার পর ক্যাপ্টেন এজাজ আমাকে প্রশ্ন করে যে, তুমি মুক্তিবাহিনী, তোমার কাছে রাইফেল আছে, তোমাদের বাহিনী কোথায় আছে আমার কছে বল। আমি তার উত্তরে উর্দুতে বলি যে, আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মানুষ, ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি, কাজেই যদি কিছু জিজ্ঞাসা করতে হয় তবে ব্যবসা সম্পর্কে করুন। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ক্যাপ্টেন সাহেবের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়। অতঃপর ক্যাপ্টেন আমাকে প্রশ্ন করে যে, তুমি এতো উর্দু কথা কেমন করে শিখেছো? তখন আমি কিছুটা ভীতু হয়ে পড়ি। কেননা আমি বৃটিশ আমলে ৭ বছর আর্মিতে চাকুরী করেছি জানতে পারলে আমাকে তখনই গুলি করে হত্যা করবে। আমি তখন বুদ্ধি খাটিয়ে বলতে লাগলাম যে, হুজুর আমি ব্যবসায়ী লোক কাজেই আমি খুলনাতে পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করি, তারা আমাকে খুব পেয়ার করে এবং প্রতি ৭ দিন অন্তর আমি তাদের কাছে ১ দিন থাকি- এই সব কথা সত্য মিথ্যা বলি। এবং সেই সঙ্গে কতকগুলি পাঞ্জাবী লোকের নাম একাধারে বলে যাই। আমার কথা ক্যাপ্টেন বিশ্বাস করে এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে যে, তোম মেরা দোস্ত হ্যায়। আরও বলে যে তুমি মুক্ত। আজ শহরে কারফিউ কাজেই সকাল বেলা তুমি তোমার ঘরে ফিরে যেও। এখন আরাম কর। এই বলে আমাকে পুনরায় সেই হাজত রুমে নিয়ে আসে। হাজত রুমে আসার পর আর যে ১৪ জন ছিল তারা আমার কাছে কাকুতি মিনতি করে নানা কথা বলতে লাগলো যে ভাই তুমি তো সকালে বাড়ী যাবে কাজেই আমাদের প্রত্যেকের বাড়ীতে তুমি সংবাদ দিবে তারা যেন টাকা পয়সা যা লাগে তাই দিয়ে আমাদের এখান থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যায়। রাত্রি ১১টার সময় একটা প্লেটে করে ৪টা রুটি ও একটু মাংস নিয়ে আসে একটা সিপাই আমার জন্য। তখন আমি জোরে জোরে বলি যে ও রুটি আমি খাব না, তোমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাও। কেননা আজ ১১ দিন হলো শুধু পানি খেয়ে আছি আর আজ শুধু আমার জন্য ৪টা রুটি এনেছো। কিন্তু এই হাজতের মধ্যে তো মোট আমরা ১৫ জন আছি, সবাই না খাওয়া, কাজেই আমি খাব না। সিপাইটি তখন ফিরে যায় এবং ক্যাপ্টেন সাহেবের কাছে সমস্ত কথা খুলে বলে। রাত্রি ১২টার সময় একটা বড় ঝুড়িতে করে রুটি ও একটা বালতিতে করে আলু ও মাংস নিয়ে আসে এবং আমাকে সবাইকে সঙ্গে করে খেতে বলে।