পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৪১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ֆb-b বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড শিরোনাম সূত্র তারিখ সাভারের কয়েকটি হত্যা কাহিনী দৈনিক সংবাদ ১১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২ আম কাঁঠালের আর শন বনে ঘেরা সাভার জনপদ আজ কাঁদছে: আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দাও শহরের একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি দূর করতে আর চিত্তবিনোদনের জন্য প্রতি রোব্বার অসংখ্য লোকের ভীড় জমে এখানে। সেই প্রকৃিতি সুন্দরী সাভার আজ হাহাকার করছে। হারানো মানিকের দিকে যেন সাভার অপলক দৃষ্টি রেখে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। কি যেন তার জিজ্ঞাসা বুঝা কঠিন। হয়তো বলবে আমার সোনার মানিকদের ফিরিয়ে দাও। কত অফুটন্ত ফুলের কুড়ি অকালে ঝরে পড়েছে। কে তার হিসাব রেখেছে। বাংলার হাটে, মাঠে, ঘাটে, ছড়িয়ে অসংখ্য নরকংকাল। এদের একত্র করলে হয়ে উঠবে এক কঙ্কালের পাহাড়। বর্বদের পৈশাচিক তা থৈ থৈ নৃত্য শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন শিয়াল, কুকুর শকুনি খুঁজে বেড়াচ্ছে এর মাংস। এমনি এক অভাগিনী স্বামীহারা সাভারের হরিপদ মজুমদারের স্ত্রী। শত্র বসনে বসে রয়েছেন। পাশেই তার ছোট বোন সান্তনা দিচ্ছে নানা কথা বলে। কিন্তু তার অবুঝ মন মানে না। কোলের শিশু নানা প্রলোভন দেখালেই কান্না থেমে যায়। হরিপদ বাবুর কথা জিজ্ঞাসা করা হলো, কিন্তু চকিত চাহনীতে তাকিয়ে আছে। কোন ভাষা নেই তার মুখে। কি যেন বলতে চাইছে অথচ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। “মুন্সগঞ্জের কেওয়াড় গ্রামের পাশে একটি খাল আছে। সেই খালের পাশে গেলে দেখতে পাবেন কতকগুলো নরকংকাল ছড়িয়ে রয়েছে এদিকে ওদিকে। ওরই মাঝে শুয়ে রয়েছে হরিপদ মুজমদারের কংকালটা।” অপলক দৃষ্টিতে দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে কথা কটি বলল মজুমদারের শ্যালিকা। হরিপদ মুজমদারের বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৫ বৎসর। কর্মজীবন সবেমাত্র শুরু। ব্যাক্তিগতভাবে তার সাথে মিশে দেখেছি। সদালাপী, শান্ত, দৃঢ়, প্রত্যয়ী এবং অমায়িক পুরুষ। ভবিষ্যত গড়ার সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা তার ছিল। ছোট সংসার। তখন মাত্র ২ টা বাচ্চাযখন তার সাথে প্রথম পরিচয়। এখন তার ৫ টি সন্তান। ফরিদপুরের মুকসুদপুরে লাইভষ্টক ডিপার্টমেন্টের ফিল্ড এ্যাসিসটেন্ট। এর উপর নির্ভর করত তার সুখের সংসার। ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন ‘সকল কলকারখানা বন্ধ। তাই কাজে যোগ দেননি। তারপর ২৫শে মার্চ নিয়ে এলো বাংলার বুকে ঘন তমসাচ্ছন্ন এক বিভীষিকাময় রাত। দিকে দিকে আগুন আর কান্নার রোল। হরিপদ মজুমদার পালাল। এসে স্থান নেয়েছিল মুন্সিগঞ্জের কেওড়ার গ্রামে। কিন্তু মৃত্যুর সাথে এত সংগ্রাম করেও সে বাঁচতে পারেনি। “পালাবার পথ নেই যম আছে পিছে।” ১৪ই মে। নেমে এলো জীবনের শেষ পরিণতি হরিপদ মজুমদারসহ আরও ২১টি নিষ্পাপ প্রাণের। পাক মেজর জাভেদ আক্তারের পরিচালনায় গ্রাম ঘেরাও করা হলো। এরা ২২ জন ধরা পড়লো। খালের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করান হলো। তারপর নৃশংস অত্যাচার। তাদের হৃদয়বিদারক চীৎকার হয়ত তখন গাছের কচি পাতাগুলোও ঝরে পড়েছিল। কিন্তু নরপশুদের এতটুকু মমতা ছিল না। হঠাৎ কয়েকবার গুলির আওয়াজ শুনা গেল। তারপর তাদের সেই মর্মস্পর্শী চীৎকার ধীরে ধীরে কোন অতল তলে তলিয়ে গেল বলা যায় না। হরিপদ মুজমদার আর নেই। কিন্তু তার পরিবারের শোকের ছায়া এখানো স্তিমিত হয় নাই। বিধবা স্ত্রী উচ্চস্বরে না কাঁদলেও তার দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রুধারা যেভাবে অঝোরে নীরবে ঝরছিল তাতেই তার শোকের পরিমাণ অনেকটা বুঝা যাচ্ছিল।