পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্থ খণ্ড).pdf/৫১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

482 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিল : চতুর্থ খন্ড আমাদের প্রতিবেশী চীনের বর্তমান নায়কেরা ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিতালী গড়ে তুলেছেন। জানি না পিছনে রাষ্ট্রগত স্বার্থ ছাড়া আর কি থাকতে পারে। আমরা তো চীনকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি নাই। চীনের বর্তমান নায়কেরা যাই বলুন না কেন মহান জাতি চীনের প্রতি কোন অবিশ্বাস আমরা পোষণ করি না। চীনের সাধারণ মানুষকে আমরা আমাদের ভালবাসাই দেই। আর আবেদন জানাই, আপনারা আপনাদের নায়কদের বাধ্য করুন- যেখানে কৃষক-শ্রমিক মরছে, যেখানে একটা জাতি নির্যাতনে নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানে একটা অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে তাঁরা সমর্থন যেন না জানায়। একটা সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে কী করে আজকে আপনাদের নায়কেরা সমর্থন করেছেন। তা একবার আপনারা দেখুন। বন্ধুরা, মনে রাখতে হবে আমাদের স্বাধীনতা অন্য কেউ এনে দেবে না। নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরকেই অর্জন করতে হবে। বাইরের কোন রাষ্ট্র স্বাধীনতার ফল এনে দেবে, এ ধারণা ভুল। দশ লক্ষ বাঙ্গালী রক্ত দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন রক্ত যখন আমরা দিতে শিখেছি তখন রক্ত আরো দেবো, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো। দশ লক্ষ বাঙ্গালীর বীর যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের কসম দিয়ে আপনাদেরকে বলছি, আজকে স্বাধীনতার লড়াই-এ প্রয়োজন পড়লে আরো আমরা প্রাণ বিসর্জন দিব। তবু আপোস করব না। ইয়াহিয়া খান সাহেব তার শেষ বেতার ভাষণে আমাদের হুমকি দিয়েছেন। এই ইয়াহিয়া খান বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের সদস্যপদ বাতিলের ব্যবস্থা করেছেন। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা নির্বাচিত সদস্য নই। বাংলার মানুষ আমাদেরকে নির্বাচিত করেছে। তাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই আজ আমরা গৃহহারা, সর্বহারা, আজ আমরা বনে জঙ্গলে ঘুরছি। কে তুমি ইয়াহিয়া? তোমাকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব কে দিয়েছে? পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও তোমাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয় নাই। নির্যাতিত পাঠান, বেলুচ, সিন্ধিদেরকেও তুমি শাসন করে চলেছো। পাঞ্জাবের চাষীমজুরদের উপর অত্যাচারে তুমি জমিদারদের সহায়তা করেছো। তোমার হুমকি ও ঔদ্ধত্যের উত্তর রণক্ষেত্রে আমাদের বীর সৈনিকেরা দেবে। সর্বশেষে আপনাদেরকে বলি সংকল্পে অটুট থাকতে হবে । দুর্বলতা কোনভাবে যেন আমাদের মনে স্থান না পায়। পরিপূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের লক্ষ্য। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বিকল্প কোন প্রস্তাব, আপনাদের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তৎসত্ত্বে ইয়াহিয়া খান সাহেবের কাছে বলেছিলাম, আহবান জানিয়েছিলাম যুদ্ধ বন্ধ করুন। আমরা দশ লক্ষ মরেছি, তোমার ১৫ হাজার সৈনিককে তো ইতিমধ্যে মুক্তি বাহিনীর লোকেরা খতম করেছে। ২৫ থেকে ৩০ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। শুধু বাংলার ঘরে ঘরে মাবোনেরা কন্দন রোল নয়, পাঞ্জাবের ঘরেও তো ক্ৰন্দনের রোল। সেখানেও বিধবার মর্মভেদী হাহাকার তোমার কানে কি পৌঁছে না? তাই যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধান কর। (১) বাংলা স্বাধীনতা স্বীকার কর। (২) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দাও। (৩) সমস্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার কর। আর (৪) যে ক্ষতি করেছ তার ক্ষতিপূরণ দাও। এই চারটি শর্ত আমি দিয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য। ইয়াহিয়া খান প্রত্যুত্তর দিয়েছেন আটাশে জুন তারিখে। আটাশের পর থেকে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ হয়েছে। এখন বাংলার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে বাংলার মাঠে, প্রান্তরে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার কলে যুদ্ধের মাধ্যমে। আপনাদের সুযোগ প্রধান সেনাপতির নির্দেশে তার সৈন্যবাহিনী রক্ত ঢেলে দিচ্ছে। তাদের সেই তপ্ত লহু আজ আপনাদের সংকল্পকে আরো দৃঢ় করুক। বাংলার যে শত শত সতী নারী তাদের ইজ্জত দিয়েছে, তাদের ইজ্জতের শপথ-ইয়াহিয়া বাহিনীকে নির্মুল না করা পর্যন্ত, বাংলার স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বিশ্রাম নাই। আপনারা সংকল্পবদ্ধ হউন, আপনারা শপথ করুন, মুক্তিযুদ্ধে যে কোন অবস্থায়, যে কোন অধ্যায়ে আপনারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন।