পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
80

ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাবস্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরূপ সংঘর্ষ শাহবাগ ও ডেমরাতে ঘটে। বাকী জায়গাগুলোয় আমার লোকেরা এমন অকস্মাৎভাবে সাবষ্টেশনগুলির ভেতর ঢুকে পড়ে যে পাকসেনারা বা পাকিস্তানী পুলিশরা কিছু বোঝার আগেই তাদের হাতে বন্দী বা নিহত হয়। এ অপারেশন-এ অন্তত ৭৫ শতাংশ সফলতা লাভ করে। ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৪ ঘণ্টার জন্য সম্পূর্ণ সচল হয়ে যায়। যদিও পাকিস্তানীরা বিমানযোগে সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসে এবং কিছুটা সরবরাহ পুনরুদ্ধার করে-তবুও শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চিরতিরে কমে যায়। এতে পাটকলগুলি চালাবার প্রচেষ্টা অনেকাংশে কমে যায়।

 এ সময়ে আমি আরো জানতে পারি যে প্রিন্স সদরুদ্দিন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঢাকায় আসছেন সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। জেনারেল টিক্কা খান সে সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিল প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বাংলাদেশে সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থা দেখাবার জন্য। আমি তার এ প্রচেষ্টাকে বানচাল করার জন্য আরো পাঁচটি দল তৈরী করি। তাদের কাজ ছিল ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো এবং অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় সে সম্বন্ধে প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী দলগুলি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটায়-প্রিন্স সদরুদ্দিনের অবস্থানকালে। সবচেয়ে বড় সবিস্ফোরণ ঘটায় মতিঝিলে। আলম এবং সাদেক এ দুজন গেরিলা ১টা গাড়ীর ভিতরে ৬০ পাউণ্ড বিস্ফোরক রেখে মতিঝিলে হাবিব ব্যাঙ্ক বিল্ডিং-এর সামনে বিলম্বিত ফিউজের মাধ্যমে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটায়। এ বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাঙ্কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঘটনায় সমস্ত ঢাকা শহর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনসাধারণ সঙ্গে সঙ্গে সব কাজকর্ম বন্ধ করে দেয়। সেদিন রাতেই প্রিন্স সদরুদ্দিন যখন হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালে বিশ্রাম করছিলেন, এ দলটি হোটেল ইণ্টারকণ্টিনেণ্টালের বারান্দায় আরেকটা বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ী বিস্ফোরণ ঘটায়। চতুর্দিকে এসব বিস্ফোরণে জাতিসংঘের মহামান্য পর্যবেক্ষক বেশ ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে টিক্কা খান যাকে স্বাভাবিকভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে, তা স্বাভাবিক নয়। ঢাকার অপারেশন যখন চলছিল তখন আমি আমার বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সেনাদের এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের মিলিত দল বিভিন্ন থানায় পাঠাচ্ছিলাম থানাগুলি দখল করে নেয়ার জন্য। এই দিনগুলি ছিল বিশেষ অসুবিধার কারণ আমার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেরাও সেনারা সবাই ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ছিল না শুধু অস্ত্র আর গোলাবারুদ। অনেক চেষ্টা করেও গোলাবারুদ এবং অস্ত্রের কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না।

 আমাদের বন্ধুরা সব সময় আমাদের আশ্বাস দিত ‘এই অস্ত্র এসে পড়ছে। কোন সময় বলত ট্রেনে মালভর্তি হয়ে গেছে, বন্যার জন্য আসতে পারছে না, কেননা রেললাইন বন্ধ। আবার কোন সময় বলত ফ্যাক্টরিতে তৈরী হচ্ছে। এমনও সময় গেছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিকল্পনা তৈরীর পর আমাদেরকে সে পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হতো অস্ত্রের অভাবে। নিজেদের কাছে যেসব অস্ত্র ছিল সেসবেরও গোলাবারুদ অত্যান্ত রেশনিং এর পরেও প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। এসময় সমস্ত মুক্তিবাহিনীতে হতাশার ভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বহু অনুরোধের পর হয়ত ৩০৩ রাইফেলের ৫ রাউণ্ড করে গুলি সাহায্য পেতাম। এ ধরনের যুদ্ধের জন্য ছিল অতি নগন্য। এসব অসুবিধা এবং সংকটের মধ্যেও আমরা ভেঙ্গে পড়িনি। আমি আমার সেনাদলকে নির্দেশ দিই, যে উপায়ে হোক আর যেখানেই হোক পাক বাহিনীকে এ্যামবুশ করে বা অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদেরকে সজ্জিত করে তুলতে হবে। এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সকলকে আত্মনির্ভরশীলতা এবং আত্মবিশ্বাস আরো বাড়াতে হবে। আমার এ নির্দেশ বেশ কাজে লাগে। সকলেই আবার পূর্ণ উদ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।

 জুলাই মাসে টিক্কা খান আবার মন্দভাগ এবং শালদা নদী পুনর্দখল করার প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানীরা বেলুচ নামক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করে। আমাকে এ খবর আমাদের লোকেরা পৌঁছায়। আমি ক্যাপ্টেন গাফফারকে মন্দভাগের অবস্থান আরো এগিয়ে বাজারের নিকট অবস্থান শক্তিশালী করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা সকালে বেলুচ রেজিমেণ্টের দুটি কোম্পানীকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়। সকাল সাড়ে দশটায় শত্রুসেনারা অবস্থানের অগ্রবর্তী স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং আমাদের মাইনফিল্ডের ভিতর আটকা পড়ে যায়।