পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
156

সময় খুব সঙ্কটজনক থাকায় দেরি না করে আমি আমার একটা প্লাটুনকে ডানদিকে একিনপুরে অবস্থান নিতে বলি। ১টা প্লাটুনকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ও লেঃ ইমামের ফাঁকা স্থানে অবস্থান নিতে বলি এবং আরেকটা প্লাটুন মুন্সিরহাটে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা যেকোন মুহূর্তে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। এই নতুন অবস্থানের পর মোটামুটি আশ্বস্ত হই কিন্তু পুরোপুরি সন্তষ্ট হতে পারিনি। তার উপর আমাদের কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, কেবলমাত্র ৩ইঞ্চি ৮১ এম এম মর্টার ছাড়া। শত্রুরা প্রতিদিন আমাদের উপর ছোট ছোট আক্রমণ চালাতে থাকে এবং আমরাও এ্যামবুশ এবং আচমকা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুদের পর্যুদস্ত করতে থাকি। শত্রুরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে কামান দিয়ে আমাদের উপর গোলা ছুড়তে থাকে এবং প্রতিদিন আমাদের কিছু কিছু লোক আহত হতে থাকে। শত্রুদেরও হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। এ সময়ে মেজর খালেদ আমাদের অবস্থান দেখতে আসেন এবং আমি সমস্ত পরিস্থিতি তাঁকে খুলে বলি। আমি আমার পরিকল্পনার কথা তাঁকে বলি এবং তিনি আমার পরিকল্পনা মেনে নেন। কিন্তু এবারও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম পরিকল্পনা মেনে নিতে রাজী হয় না। কিন্তু ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম স্থানীয় লোক হওয়ায় মেজর খালেদ তাকে আর চাপ দেয় না। যাই হোক, আমাকে আমার পুরাতন অবস্থানই রাখতে হলো। আমরা মেজর আমিনকে খাদ্য ও অস্ত্র সরবরাহের দিকে লক্ষ্য রাখতে বললাম। এ অবস্থানে আমরা কয়েকদিন অর্ভুক্তও ছিলাম। তখন ছিল বর্ষাকাল। রাস্তাঘাট কাদায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রশস্ত্র ১৪ মাইল দূরে বেলুনিয়া থেকে কাঁদা ভেঙ্গে আনতে হত। এ অসুবিধা সত্ত্বেও মেজর আমিন যতখানি পেরেছেন আমার জন্য করেছেন। তিনি কাঁদার রাস্তা ভেঙ্গে যত দ্রুত অস্ত্রশস্ত্র ও খাবার পৌঁছানো যায় তার ব্যবস্থা করেছেন। ভারতীয় বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর যাতে সাহায্য পাওয়া যায় তার চেষ্টা আমরা করেছিলাম কিন্তু তা সফল হয়নি। গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য না পেলেও মিত্র বাহিনীর সেনারা মর্টারের সাহায্যে তাদের উপর গোলা ছুড়েছিল। এটা আমাদের মনোবল বাড়াতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। আমার সৈনিকরা এত উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল যে তারা বাঙ্কার ছেড়ে বেরিয়ে এসে বলতে থাকে, “স্যার ভারতীয় বাহিনী যদি আমাদের সাহায্য করে, তবে আমরা আজই ফেনী দখল করে নিতে পারব।” কিন্তু এটা যে সম্ভব নয় তা আমার সৈন্যদের বুঝানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল।

 আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরানো আমলের এবং অতি সামান্য। সে তুলনায় শত্রুদের শক্তি ছিল একটা ব্রিগেড, এক রেজিমেণ্ট আর্টিলারী ও ট্যাঙ্ক বাহিনী। এ ছাড়া ছ'টি হেলিকপ্টার ছিল শত্রুসেনাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাবার জন্য। মর্টার ছাড়াও কিছু মেশিনগান ও হালকা মেশিনগান আমাদের সঙ্গে ছিল।

 যাহোক, আমরা আচমকা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুদের ব্যতিব্যস্ত রাখছিলাম। আমরা প্রতিদিন তাদের অনেককেই হতাহত করছিলাম। তাদের শক্তি অত্যধিক হওয়ায় তারা হতাহতের স্থান পূরণ করতে পারছিল। আমাদের হতাহতের সংখ্যা সামান্য হলেও তা পূরণ করতে আমরা সমর্থ ছিলাম না। আমরা চিন্তা করছিলাম শত্রুরা যে কোন মুহূর্তে প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। '৭১-এর ১৭ই জুন সকালে শত্রুরা গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের সাহায্য নিয়ে আমাদের উপর নতুন আক্রমণ শুরু করেছিল। কামান ছাড়াও শত্রুদের আর- আর, মর্টার, মেশিনগান, চাইনিজ রাইফেল তো ছিলই। আমাদের অবস্থানের অবস্থা থেকে সহজেই বুঝা যায় এ এক অসম যুদ্ধ। পাকিস্তানী সৈন্যরা সাত ঘণ্টা ধরে স্রোতের মত এগোতে থাকে। সাত ঘণ্টা পর আমাদের হাতে চরম মার খেয়ে তার পিছু হটে যায়। এমনকি তারা তাদের অনেক মৃতদেহ ইলোনিয়া নদী ও অন্যান্য স্থানে ফেলে রেখে পালায়। মৃতদেহগুলি পরে শকুন এবং কুকুরে খায়।

 পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান তখন ঢাকাতে ছিলেন। ফেনীর খবর শুনে তিনি নিজে এর গুরুত্ব বুঝাবার জন্য ফেনীতে আসেন। তিনি ফেনীতে এসে ধারণা করেন মুজিবনগর আশেপাশেই আছে। সেহেতু মুন্সিরহাট দখল করার জন্য তিনি নিজে এবং দু'জন ব্রিগেডিয়ারকে নিয়ে আমাদের তিনজন ক্যাপ্টেন ও একজন লেফটেন্যাণ্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে বুঝিয়ে দেন যে বঙ্গশার্দুলরা তাদের থেকেও কম নয়। এ যুদ্ধ আমাদের জন্য এক বিরাট গৌরব। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের এক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দেন ফ্রণ্টিয়ার ফোর্সের মেজর আশিফ, যার সাথে আমরা একসঙ্গে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে ছিলাম।